সাক্ষাৎকার

আরও বেশি প্রতিযোগী থাকলে ই-কমার্সের ব্যবসা ভালো হতো

চীনের ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবা দেশীয় ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান দারাজকে ২০১৮ সালে অধিগ্রহণ করে। দারাজ বাংলাদেশ সম্প্রতি ১১.১১ শীর্ষক প্রচারণা চালিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগ ও ই–কমার্স খাত নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দারাজ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মোস্তাহিদল হক। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম

প্রথম আলো:

আপনাদের ১১.১১ ক্যাম্পেইন বা প্রচারণায় কেমন সাড়া পেয়েছেন?

সৈয়দ মোস্তাহিদল হক: প্রতিবছরই ১১.১১ প্রচারণাটি করে থাকে দারাজ। চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সাড়া কেমন পাব, তা নিয়ে একটু শঙ্কায় ছিলাম। তবে প্রচারণার শুরু থেকেই ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। তাতে শেষ পর্যন্ত আমাদের বিক্রির লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়েছে। এই প্রথমবারের মতো প্রথম দিনেই ১০ লাখ ক্রয়াদেশ পেয়েছি আমরা। প্রচারণার সময় সব ধরনের পণ্যই মোটামুটি বিক্রি হয়েছে। তবে ফ্যাশন, ইলেকট্রনিক, মুদি ও লাইফস্টাইল পণ্য বেশি বিক্রি হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর পণ্য বিক্রিতে ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

প্রথম আলো:

দেশের ই–কমার্স খাতে দারাজের অবস্থান এখন কোথায়?

সৈয়দ মোস্তাহিদল হক: বৈশ্বিক চর্চা অনুসারে ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ৩৬০ ডিগ্রি ধরনের মার্কেটপ্লেস হয়। অর্থাৎ এখানে বহু ক্রেতা, বিক্রেতা ও পণ্যের সম্মিলন হয়ে থাকে। পাশাপাশি ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্য উন্নত ধরনের লেনদেন, লজিস্টিক বা সরবরাহ ও অন্যান্য পরিষেবা থাকবে। নিজের পণ্য নিজের ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজে বিক্রি করলে সেটিকে প্রকৃত অর্থে ই–কমার্স বলা যায় না। এসব দিক বিবেচনায় দারাজ বর্তমানে দেশে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। আমরা মূলত সঠিক পণ্যের সঙ্গে সঠিক গ্রাহককে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।

পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ফেসবুক পেজভিত্তিক ব্যবসা থেকে কিছু প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যেমন বিভিন্ন হিসাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দেশে ৫০ হাজারের বেশি ফেসবুক পেজ রয়েছে, যারা পণ্য বিক্রি করে। এসব পেজ প্রতিদিন একটি অর্ডার পেলেও সংখ্যাটা ৫০ হাজার ছাড়ায়। এই সংখ্যা কিন্তু অনেক বেশি।

প্রথম আলো:

দেশে সার্বিক খুচরা বিক্রির তুলনায় ই–কমার্স ব্যবসার অবস্থান কোন পর্যায়ে?

সৈয়দ মোস্তাহিদল হক: সার্বিক রিটেইল বা খুচরা বিক্রির তুলনায় দেশের ই–কমার্স এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা গ্রাহকের দীর্ঘদিনের অভ্যাসে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। ৯ বছরের পরিশ্রমে আমরা সার্বিক খুচরা বিক্রির মাত্র ১.৫ শতাংশ হিস্যা ই–কমার্সে আনতে পেরেছি। যেখানে ভারতে এই হার প্রায় ৭ শতাংশ, চীনে ৩০ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ায় ১৪ শতাংশের মতো। এই হিস্যা বাড়াতে ভোক্তা ও বিক্রেতাকে শিক্ষিত করা, অবকাঠামোগত খাতে বিনিয়োগ করা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন—এসব কাজ আমাদের এককভাবে করতে হচ্ছে। এ জন্য প্রবৃদ্ধির গতিও কম। দেশে আরও কয়েকটি প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান থাকলে কাজটা অনেক সহজ হতো।

প্রথম আলো:

প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় ই–কমার্সে বাংলাদেশ পিছিয়ে কেন?

সৈয়দ মোস্তাহিদল হক: এই পিছিয়ে থাকার ক্ষেত্রে চারটি প্রধান কারণ রয়েছে। এক. বাংলাদেশে ই–কমার্সের যাত্রা অনেক দেরিতে শুরু হয়েছে। দুই. দেশে স্মার্ট লজিস্টিক নেটওয়ার্ক অনেক পরে এসেছে। তিন. ক্রেতাদের বড় একটি অংশ এখনো নগদ টাকায় লেনদেনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। চার. ছোট দেশ হওয়ায় স্থানীয় পর্যায়ে সরাসরি কেনার মতো পণ্যের সরবরাহ বেশি থাকে। তবে আশা করছি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে ই–কমার্সের অবদান সার্বিক খুচরা বিক্রির ৫ শতাংশ ছাড়াবে।

প্রথম আলো:

ই–কমার্সের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। এক পণ্য দেখিয়ে অন্য পণ্য দেওয়ার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়।

সৈয়দ মোস্তাহিদল হক: যেসব দেশে ই–কমার্স ভালো করছে, সেখানে আগে ভালো সরবরাহব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। তারপর ই–কমার্স এসেছে। এরপর ফেসবুককেন্দ্রিক বেচাকেনা বেড়েছে। বাংলাদেশে হয়েছে উল্টো। পদ্ধতিগতভাবে না এগোনোয় অনলাইন বেচাকেনা নিয়ে মানুষের বিশ্বাসের জায়গায় শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। এ নিয়ে ভোক্তাদের সচেতনতা বাড়াতে আমাদের কাজ করতে হয়েছে। এখন পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে।
ই–কমার্স প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রে এক পণ্য দেখিয়ে অন্য পণ্য বিক্রির সুযোগ কম। কারণ, এখানে যথাযথ তদারকি ও জবাবদিহির প্রক্রিয়া মানা হয়। পণ্য নিয়ে কোনো অসন্তোষ থাকলে আমাদের আনুষ্ঠানিক রিফান্ড পলিসি রয়েছে। তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে দারাজের ক্ষেত্রেও কখনো এমন ঘটতে পারে। সে ক্ষেত্রে গ্রাহক অভিযোগ করলে আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি সমাধান করে থাকি। এমনকি বিক্রেতার কোনো দায় পাওয়া গেলে ওই বিক্রেতাকে ডিলিস্ট করাসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বিক্রয়–পরবর্তী পরিষেবার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর বিক্রয়কেন্দ্র থেকে কিনলে যে সুবিধা পাওয়া যায়, দারাজের ক্ষেত্রেও একই সুবিধা পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে বলতে পারি, গ্রাহক সন্তুষ্টিই আমাদের কাছে প্রধান বিষয়।

প্রথম আলো:

বিক্রয়কেন্দ্রের তুলনায় অনলাইন কমার্সে পণ্যের দাম বেশি নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

সৈয়দ মোস্তাহিদল হক: দারাজের ক্ষেত্রে আমরা প্রতিনিয়ত পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক দাম (প্রাইজ কমপিটিটিভনেস) যাচাই করি। তাতে দেখা গেছে, দারাজে ৮০-৮৫ শতাংশ পণ্যের দাম তুলনামূলক কম থাকে। বিষয়টি আরও ক্রেতাবান্ধব করতে আমরা পণ্যের রিভিউ, রেটিং, মন্তব্য ও বিক্রেতার সঙ্গে সরাসরি চ্যাট করার সুযোগগুলোর ওপর জোর দিয়ে থাকি। তবে সার্বিকভাবে পণ্য বিক্রির পরিমাণ বাড়লে দামে আরও ছাড় পাওয়া যাবে।

প্রথম আলো:

২০১৮ সালে দারাজকে অধিগ্রহণ করেছে চীনের ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবা। এরপর কী পরিবর্তন এসেছে?

সৈয়দ মোস্তাহিদল হক: তিনটি জায়গায় বড় পরিবর্তন এসেছে। এক. সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে প্রযুক্তি ব্যবহারে। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চালিত দারাজ অ্যাপের মাধ্যমে সমন্বিত স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। দুই. বড় বিনিয়োগ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানের বিপণন ও অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। তিন. আলিবাবার দীর্ঘদিনের ই–কমার্সের অভিজ্ঞতা আমরা পেয়েছি।

প্রথম আলো:

ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ই–কমার্সের ট্রেন্ড কী রকম দেখছেন?

সৈয়দ মোস্তাহিদল হক: পাঁচ বছর আগে ৩৫ শতাংশ ক্রয়াদেশ ঢাকার বাইরে থেকে আসত; যা এখন বৃদ্ধি পেয়ে ৬০ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ ঢাকার বাইরে দ্রুত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। মূলত এটা সম্ভব হয়েছে স্মার্ট লজিস্টিক নেটওয়ার্কের কারণে।

প্রথম আলো:

ডিজিবক্সের মতো দারাজের আরও নতুন কী ধরনের উদ্ভাবন রয়েছে।

সৈয়দ মোস্তাহিদল হক: গ্রাহকদের স্বাচ্ছন্দ্যে পণ্য গ্রহণের সুবিধা দিতে ডিজিবক্স সেবা চালু করেছে দারাজ। এখন পর্যন্ত সব জেলা শহরে এই সেবা পৌঁছেছে। এটিকে আরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। কিছুদিন আগে দারাজ অ্যাপে গেম চালু করেছি। এ ছাড়া দারাজ অ্যাপে লাইভ স্ট্রিমিং ও বিক্রেতাদের পণ্য রপ্তানির সুযোগ দেওয়া নিয়ে কাজ আমরা করছি। বর্তমানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার—এই পাঁচ দেশে দারাজ কাজ করছে।

প্রথম আলো:

দারাজে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সব মিলিয়ে ৯ বছর ধরে কাজ করছেন। কাজের অভিজ্ঞতা কেমন? ই–কমার্সের নতুন প্রজন্ম নিয়ে কী ভাবনা রয়েছে?

সৈয়দ মোস্তাহিদল হক: প্রতিনিয়ত নতুন চ্যালেঞ্জ পাওয়া এবং সেটি মোকাবিলায় নতুন কৌশল গ্রহণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই ই–কমার্সের ওপর আরও নির্ভরতা বাড়বে, এটাই বাস্তবতা। এ জন্য আমাদের আরও প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি।