যেভাবেই হোক মানুষকে সহায়তা দিতে হবে

অর্থনীতির বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি ও উত্তরণের উপায় নিয়ে প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া বর্তমান অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হবে। নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষে বড় ধরনের সংস্কার সম্ভব নয়। তবে নির্বাচনের পর সংস্কারের কৌশল কী হবে, তা এখনই ঠিক করতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ছিলেন চার অর্থনীতিবিদ, একজন সাবেক ব্যাংকার ও একজন ব্যবসায়ী।

সায়েমা হক, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম আলো

আমরা অনেক কিছু্ই করি; কিন্তু সমস্যা হলো, সেগুলো করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যায়। আমাদের অগ্রাধিকার ঠিক নেই। সমন্বয়ের অভাবে পরিস্থিতি জটিল হয়। স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় থাকে না; আমরা অনেক সময় অ্যাডহক ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিই বা কাজ করি।

আবার অনেক সময় বড় সমস্যা মোকাবিলায় ব্যবস্থা নিই না, যে কারণে অন্যান্য সমস্যা ঘনীভূত হয়। যেমন: প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা; যার একটি রূপ হচ্ছে রাজস্ব খাতের সমস্যা; বাকি দুটি হচ্ছে আর্থিক খাত ও সরকারি ব্যয়ের খাত।

এসব নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। মোদ্দাকথা হচ্ছে, এগুলো হচ্ছে মূল সমস্যা; এসব সমস্যার সমাধান না হলে আমরা অন্যান্য সমস্যা থেকে বেরোতে পারব না।  

এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রিজার্ভ, ডলার ও খেলাপি ঋণ—এগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে কিছু সমস্যা আমরা চাইলেই এখন সমাধান করতে পারব না, যেমন রপ্তানি বহুমুখীকরণ নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা হচ্ছে; কিন্তু হঠাৎ করে সেটি হবে না।

তবে কিছু কিছু বিষয়ে আমরা এখনই ব্যবস্থা নিতে পারি, যেমন আমদানি রপ্তানি পর্যায়ে আন্ডার ইনভয়েসিং–ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়ে এখনই ব্যবস্থা নিতে পারি। তারপর আছে হুন্ডি, যার সঙ্গে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী কমে যাওয়ার সম্পর্ক আছে, এ বিষয়েও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

অনেক সময় দেখা যায়, ছোট ঋণখেলাপি বা ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার করখেলাপিদের নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা হয়; কিন্তু যাঁরা শত শত কোটি টাকার খেলাপি হন, তাঁদের বিষয়ে কিছু বলা হয় না। এটা সমস্যা। কারণ, এতে বোঝা যায়, আমাদের অগ্রাধিকার ঠিক নেই।

মূল্যস্ফীতি ও বৈষম্য এখন নিম্ন আয়ের মানুষের মূল সমস্যা। বৈষম্যের কথা তাঁরা সরাসরি না বললেও বিষয়টি তাদের ধারণার মধ্যে আছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আর্থিক ও রাজস্বনীতি ব্যবহার করা যায়; এর বাইরে আছে মূল্যস্ফীতির কিছু অদৃশ্য কারণ, যেমন চাঁদাবাজি। পথে পথে চাঁদা দিতে হয় বলে ছোট ব্যবসায়ীরা শেষমেশ সেই দায়ভার ক্রেতার ওপর চাপিয়ে দেন।

মূল্যস্ফীতির অদৃশ্য কিছু কারণও রয়েছে, যেমন–চাঁদাবাজি। পথে পথে চাঁদা দিতে হয় বলে ছোট ব্যবসায়ীরা শেষমেশ সেই দায়ভার ক্রেতার ওপর চাপিয়ে দেন।

সরকার যদি সমবায়পদ্ধতির বাজারব্যবস্থায় উৎসাহ দেয়, যেমন সরকার কিছু কিছু জায়গায় বাজার বসানোর অনুমতি দিয়ে ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখলে, কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই উপকৃত হবেন। সে জন্য সরকারকে অর্থ ব্যয় করতে হবে না, কেবল ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখলেই চলবে।

বাজারব্যবস্থায় আমরা সিন্ডিকেটের কথা শুনি; কিন্তু সিন্ডিকেটের যাঁরা মাথা, তাঁদের ধরা যায় না। দেশে যে আর্থিক নীতি, সেটি তেমন কাজ করে না, এটিই এর মূল কারণ। তারপরও আর্থিক নীতির ব্যবহার করতে হবে, যদিও সরকার অনেক দিন নীতি সুদহার কম রাখার পাশাপাশি সুদের নয়–ছয় হার বজায় রেখেছে। কিন্তু এগুলো ব্যবহার করতেই হবে। মুদ্রার বিনিময় হার ও সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত সামাজিক নিরাপত্তা খাত। এই খাতে রীতিমতো বিপ্লব প্রয়োজন। এখন মাথাপিছু ৫০০ বা ৭০০ টাকা দিলে চলবে না; সেই সঙ্গে উপকারভোগী কারা হবেন, তা নির্ধারণে আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে যখন কাজ হচ্ছে না, তখন এ ধরনের ব্যষ্টিক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে যত সুযোগ আছে, তার সবই কাজে লাগানো প্রয়োজন।

যেভাবেই হোক, মানুষকে সহায়তা দিতে হবে। এখন এক ধরনের কৃচ্ছ্র সাধনের নীতিতে আমরা আছি, ফলে কর্মসংস্থানও যে খুব একটা বাড়বে, সেই আশা দুরাশা। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাচ্ছে, সে কারণে শিল্পায়ন হচ্ছে না। এত দিন যে সুদের হার কম ছিল তাতে বেসরকারি ঋণপ্রবাহ বাড়েনি। তাই এত দিন কেন ঋণের সুদহার বেঁধে রাখা হলো, তা–ও খতিয়ে দেখা দরকার। বর্তমান পরিস্থিতিতে সিএমএসই বা এসএমই খাতে ঋণ বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।    

বাজেটে সরকার যে প্রণোদনা দেয়, তার জন্য কিছু শর্ত দেওয়া যেতে পারে। যেমন শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা, রেশন দেওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ শ্রমিকদের জন্য অনুকূল ব্যবস্থা নেওয়া হলেই কেবল এসব প্রণোদনা দেওয়া হবে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের ছোট পদক্ষেপ নিম্ন আয়ের মানুষকে সমর্থন দিতে পারে।

মোদ্দাকথা, মূল্যস্ফীতি এমনিতেই লাগামছাড়া হয়ে গেছে, কোনোভাবে তা সামাল দিতে হবে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা না গেলে এসব সমস্যার সাময়িক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হবে না।