চতুর্থ সুকুক আসছে বাজারে

দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কার্যক্রমে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং খাতের তারল্যকে সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে ব্যবহারের লক্ষ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি বন্ড বা ‘সুকুক চালু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।  

একদিকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিনিয়োগকারীর সুদযুক্ত টি-বিল, বন্ড ও অন্যান্য সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতে অনাগ্রহ, অন্যদিকে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচলিত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় তাদের অধিকাংশ তারল্য অব্যবহৃত থেকে যেত। এই পরিস্থিতিতে সরকার ৮ অক্টোবর, ২০২০ তারিখে ‘বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ সুকুক গাইডলাইন, ২০২০’ জারি করে স্পেশাল পারপাস ভেহিকেল (এসপিভি) ও ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে মনোনীত করে। এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সুকুক ইস্যুর ক্ষেত্রে অরিজিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। পাশাপাশি একটি শক্তিশালী শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কমিটিও আছে।

ইতিমধ্যে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সরকার তিনটি স্বতন্ত্র বিনিয়োগ সুকুক ইস্যুর মাধ্যমে ১৮ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। এর ধারাবাহিকতায় ‘চট্টগ্রাম বিভাগের উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়ক প্রশস্তকরণ ও শক্তিশালীকরণ (সিডিডব্লিউএসপি)’ শীর্ষক প্রকল্পের বিপরীতে ইসতিস্না ও ইজারা পদ্ধতিতে ১০০০ কোটি টাকা অভিহিত মূল্যের পাঁচ বছর মেয়াদি চতুর্থ বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ সুকুক ইস্যু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

উল্লিখিত প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ সুকুক (সিডিডব্লিউএসপি সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট সুকুক)) ইস্যুর জন্য প্রণীত প্রসপেক্টাস বাংলাদেশ ব্যাংকের শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কমিটির অনুমোদনক্রমে চূড়ান্ত করা হয়েছে। বর্ণিত সুকুকের নিলাম বা অকশন ৫ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। প্রসপেক্টাস অনুযায়ী ইসতিস্না ও ইজারা পদ্ধতিতে সুকুক ইস্যু করা হবে, যার মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ৬ জুন, ২০২৯। এই সুকুকে বিনিয়োগের বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের ভাড়া হিসেবে বার্ষিক ১০৪ কোটি (১০.৪০% হারে) টাকা ষাণ্মাসিক ভিত্তিতে পরিশোধ করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চলতি/আল-ওয়াদিয়াহ হিসাব আছে, এমন সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরাসরি নিলামে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগকারীসহ বিমা কোম্পানি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স ফান্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চলতি/আল-ওয়াদিয়াহ হিসাব আছে, এমন ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিলামে অংশগ্রহণ করতে পারবে।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হয়, যার পরিকল্পনা হয় প্রতি অর্থবছরের বাজেটে। সাধারণত ঘাটতি বাজেট পূরণে সরকার প্রচলিত ব্যাংকগুলো থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। ব্যাংকিং খাতে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা মোট সম্পদের প্রায় এক–চতুর্থাংশ সরকারি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের লক্ষ্যে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবহারের জন্য সরকারের ইসলামি বন্ড বা সুকুক চালু করার ভাবনা আসে। বর্তমানে কনভেনশনাল ব্যাংকের গ্রাহকদের কাছে সুকুকের ব্যাপক চাহিদা থাকায় বর্তমানে চতুর্থ সুকুকটি অধিকতর সর্বজনীন করা হয়েছে।

‘সুকুক’ শব্দটি প্রকৃতপক্ষে ‘সক্ক’ শব্দটির বহুবচন—এটি একধরনের আইনগত দলিল বা চুক্তি। সুকুকের প্রথম প্রচলন সপ্তম শতাব্দীতে, বর্তমান সিরিয়ার দামেস্কে। সুকুক হলো কোনো সেবা, প্রকল্প, বিনিয়োগ কিংবা কোনো স্থাবর সম্পদ বা তা ভোগদখলের অধিকারের অবিভাজিত স্বত্বের প্রতিনিধিত্বকারী ইসলামসম্মত সনদ। অর্থাৎ সুকুক হচ্ছে কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পদ কিংবা কোনো সেবার আংশিক মালিকানা নির্দেশকারী দলিল।

প্রচলিত বন্ডের সঙ্গে সুকুকের মূল পার্থক্য হলো সুকুক কোনো সম্পদের ওপর স্বত্ব বা মালিকানার ভিত্তিতে ইস্যু করা হয়। যার অর্থ, সুকুক কোনো ঋণ নয়, বরং একার্থে এটি আংশিক মালিকানা বা স্বত্ব। সুকুকের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর পরিচালনা সম্পূর্ণভাবে শরিয়াহভিত্তিক হওয়ায় এতে রিবা বা সুদ নেই। হয় শরিয়াহর বিধিবিধান সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করে সুকুক ইস্যু ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সুকুক ইস্যুর মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ কেবল শতভাগ শরিয়াহসম্মত কোনো প্রকল্পেই ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া শরিয়াহভিত্তিক হওয়ায় সুকুকের মুনাফা কেবল বিনিয়োগ আয় থেকেই দেওয়া যাবে এবং এই মুনাফার হার পূর্বনির্ধারিত (ফিক্সড) নয়। কিন্তু প্রচলিত বন্ডের সুদ পূর্বনির্ধারিত—বন্ড থেকে উত্তোলিত অর্থ সুনির্দিষ্ট প্রকল্পে ব্যয়ের বাধ্যবাধকতা নেই এবং তা কোনোভাবেই সম্পদের মালিকানাও নির্দেশ করে না।

সুকুক ইস্যুতে বিভিন্ন ধরনের কাঠামো বা পদ্ধতির অনুসৃত হতে পারে, যেমন মুদারাবা, মুশারাকা, মুরাবাহা, ইসতিস্না, সালাম, ইজারা, করজে হাসানা ইত্যাদি। চট্টগ্রাম বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়ক প্রশস্তকরণ ও শক্তিশালীকরণ (সিডিডব্লিউএসপি) শীর্ষক প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ একেবারেই প্রারম্ভিক পর্যায়ে। ফলে ইসতিস্না ও ইজারা পদ্ধতিতে আলোচ্য চতুর্থ সুকুকটি ইস্যু করা হবে। ইসতিস্না হলো এমন একটি চুক্তি, যার মাধ্যমে একটি পক্ষ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে অন্য পক্ষের জন্য একটি নির্দিষ্ট পণ্য (এসেট বা প্রজেক্ট) তৈরি ও সরবরাহে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। অন্যদিকে ইজারা সুকুক ভাড়া দেওয়া সম্পত্তিতে সমান শেয়ারের প্রতিনিধিত্ব করে।

সম্পত্তি বা সম্পদের মালিক ভাড়া প্রদানের বিনিময়ে সম্পত্তিটি লিজ বা ইজারা দেওয়ার জন্য ইজারা সুকুক ইস্যু করে। সুকুক ধারকেরা সাবস্ক্রিপশনের বিনিময়ে অন্তর্নিহিত সম্পদের মালিক হন। আলোচ্য চতুর্থ সুকুকটি ইসতিস্না ও ইজারা পদ্ধতিতে ইস্যু করা হবে, যেখানে সুকুক সম্পদ প্রস্তুত করা হবে ইসতিস্না চুক্তির আওতায় এবং পরবর্তীকালে প্রস্তুতকৃত সম্পদ ইজারা চুক্তির আওতায় ইজারা দিয়ে প্রাপ্য ভাড়া সুকুক ধারকদের মুনাফা হিসেবে দেওয়া হবে। বর্তমানে সুকুক ইস্যুর অরিজিনেটর, ইনভেস্টর বা বিনিয়োগকারী, স্পেশাল পারপাস ভেহিকেল (এসপিভি) ও ট্রাস্টি নিজস্ব ভূমিকায় যথেষ্ট সক্রিয়। সুকুকটি ইসলামি আইন মোতাবেক ইস্যু ও পরিচালিত হওয়ার বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নিয়োজিত শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কমিটি (শরিয়াহ পরামর্শক কমিটি) সুকুক ইস্যুর প্রক্রিয়া, ইস্যুর মাধ্যমে সংগৃহীত তহবিলের ব্যবহারের সঠিকতা, ইজারার বিপরীতে ভাড়া নির্ধারণ প্রক্রিয়া ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে শরিয়াহ নির্দেশনা পরিপালন করে পরিচালিত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছে।

বিনিয়োগকারীদের ধরন অনুযায়ী তাদের অনুকূলে চতুর্থ সুকুক বরাদ্দের ক্ষেত্রে সুকুক বরাদ্দের শতকরা হার হবে যথাক্রমে (১) শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা কোম্পানি—ইস্যুতব্য সুকুকের ৮৫ শতাংশ, (২) প্রচলিত মূল ধারার ব্যাংকগুলোর ইসলামিক শাখা ও উইন্ডোজ—ইস্যুতব্য সুকুকের ১০ শতাংশ ও (৩) ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগকারী, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স প্রভৃতি—ইস্যুতব্য সুকুকের ৫ শতাংশ।

এ ছাড়া উল্লিখিত তিনটি শ্রেণির পাশাপাশি সব প্রচলিত ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান/বিমা কোম্পানি সুকুকের নিলামে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে সুকুক বরাদ্দের ক্ষেত্রে তিনটি ধাপ অনুসরণ করা হবে, যথা—(ক) তিনটি শ্রেণিতেই নির্ধারিত অনুপাতের চেয়ে বেশি বিড বা দরপত্র দাখিল হলে প্রতি শ্রেণির বিড দাখিলকারীদের মধ্যে সমানুপাতিক হারে (প্রো-রাটা বেসিস) সুকুক বরাদ্দ দেওয়া; (খ) কোনো শ্রেণিতে নির্ধারিত অনুপাতের চেয়ে কম দরপত্র দাখিল হলে এবং অন্য কোনো শ্রেণিতে নির্ধারিত অনুপাতের চেয়ে বেশি বিড দাখিল হলে অবশিষ্ট সুকুক বেশি বিড দাখিলকারীদের মধ্যে সমানুপাতিক হারে (প্রা-রাটা বেসিস) বরাদ্দ দেওয়া এবং (গ) উল্লিখিত তিনটি শ্রেণিতে প্রয়োজনীয় সাবস্ক্রিপশন না পাওয়া গেলে নিলামে অংশগ্রহণকারী প্রচলিত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা কোম্পানির মধ্যে অবশিষ্ট সুকুক আনুপাতিক হারে বরাদ্দ দেওয়া।

সুকুক-১: ‘সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের’ বিপরীতে ৮ হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের লক্ষ্যে দুই ধাপে প্রথম বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ সুকুক ইস্যু করা হয় যথাক্রমে ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ ও ১০ জুন ২০২১ তারিখে, যেখানে ৪৭ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকার দরপত্র দাখিল হয়েছিল। পাঁচ বছর মেয়াদি এই ইজারা সুকুকের ভাড়ার হার ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ; আগামী ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে এটি মেয়াদোত্তীর্ণ হবে। আলোচ্য প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কাজ করছে। বর্তমানে এর ৪৯ দশমিক ৩১ শতাংশ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে।

সুকুক-২: ‘চাহিদাভিত্তিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প (১ম পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের বিপরীতে ৫০০০ কোটি টাকার ০৫ বছর মেয়াদি ২য় সুকুক ইস্যু করা হয় ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে, যেখানে ২৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার দরপত্র দাখিল হয়েছিল। সুকুকটি ইজারা পদ্ধতিতে ইস্যু করা হয়েছে এবং বিনিয়োগকারীদের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ হারে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। আলোচ্য প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। বর্তমানে এর শতভাগ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে।

সুকুক-৩: ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩’ শীর্ষক প্রকল্পের বিপরীতে ২০ এপ্রিল ২০২২ তারিখে ৫ হাজার কোটি টাকার পাঁচ বছর মেয়াদি আইআরডিপি-৩ সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট সুকুক নামে তৃতীয় সুকুক ইস্যু করা হয়, যেখানে ১২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকার দরপত্র দাখিল হয়েছিল। সুকুকটি ইসতিস্না ও ইজারা পদ্ধতিতে ইস্যু করা হয়েছে এবং সুকুক ধারকদের ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। আলোচ্য প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কাজ করছে। বর্তমানে এর ৫২ দশমিক ৬৬ শতাংশ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে।

লেখক: পরিচালক (ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট), বাংলাদেশ ব্যাংক; সদস্যসচিব, শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কমিটি, বাংলাদেশ ব্যাংক।