বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ইউয়ান ব্যবহারের প্রস্তাব চীনের

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের একটি দল গত মাসের শেষের দিকে চীন সফর করেন। উদ্দেশ্য ছিল একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে চীনা মুদ্রা ইউয়ানকে কীভাবে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে আলোচনার জন্য সেমিনারটির আয়োজন করা হয়েছিল। ওই সেমিনারে যোগ দিয়েছিলেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খায়রুল আলম চৌধুরী

চীনা মুদ্রা ইউয়ানছবি: এএফপি

বাংলাদেশকে ডলারের পরিবর্তে সরাসরি ইউয়ান বা আরএমবিতে লেনদেন নিষ্পত্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে চীন। গত মে মাসের ২৯–৩০ তারিখে ব্যাংক অব হুজো আয়োজিত ‘প্রমোশন অব ক্রস বর্ডার আরএমবি সেটেলমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সেমিনারে এ প্রস্তাব দিয়েছে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়না। অনুষ্ঠানে ডলারের বদলে ইউয়ানে লেনদেন নিষ্পত্তি করলে পারস্পরিক কী সুবিধা হতে পারে, তা তুলে ধরেন চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি।

চীন থেকে আমদানি বাবদ বাংলাদেশকে প্রতিবছর প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়, যা মোট আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশ। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি ব্যাখ্যা করেন যে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক এ লেনদেন যদি ইউয়ান বা আরএমবিতে করা হয়, তাহলে বেশ কিছু সুবিধা পেতে পারে বাংলাদেশ।

অন্তত ছয়টি সুবিধার কথা উল্লেখ করেন চীনা প্রতিনিধি। প্রথমত, বাংলাদেশের রিজার্ভের ডলারের ওপর চাপ কমবে; দ্বিতীয়ত, আমেরিকান ক্লিয়ারিং সিস্টেম ব্যবহারের জন্য ঋণপত্র বা এলসিপ্রতি মাশুল বাবদ এখন যে ১৮০–২০০ ডলার দিতে হয়, সরাসরি টাকা-আরএমবি লেনদেনে এ অতিরিক্ত খরচ ব্যবসায়ীদের বহন করতে হবে না; তৃতীয়ত, চীন থেকে আমদানি ক্ষেত্রে উপযুক্ত মূল্যে লেনদেনের নিশ্চয়তা বাড়বে; চতুর্থত, আরএমবি হিসাবের জমা থেকে লেনদেন নিষ্পত্তি হলে বিনিময় ঝুঁকি দূর হবে; পঞ্চমত, হংকং, সাংহাই, সিঙ্গাপুরের মুদ্রাবাজারে আরএমবি সম্পদে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকবে। সর্বপোরি যেকোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন ঝুঁকিও এড়ানো সম্ভব হবে।

চীন বাংলাদেশে আরএমবিতে হিসাব খোলা এবং বাণিজ্যিক লেনদেন সম্পন্ন করার কথা বলেছে। এ জন্য আরএমবি লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা ক্রস বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম বা সিআইপিএসে যোগ দিতে হবে। এ নিকাশ ব্যবস্থায় চীনের সঙ্গে এখন যুক্ত আছে হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমার।

বাংলাদেশে অবশ্য এখনই আরএমবিতে হিসাব খোলা যায় এবং আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে আরটিজিএস (রিয়াল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট, যেটি এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে তাৎক্ষণিক তহবিল স্থানান্তর ব্যবস্থা) নিকাশ ব্যবস্থায় স্থানীয় লেনদেনও নিষ্পত্তি করা যায়। এদিক থেকে বাংলাদেশের নীতি-কাঠামো অনেক দূর এগিয়ে আছে। ইউয়ানে বাণিজ্য নিষ্পত্তি করতে হলে এখন দরকার হবে আরএমবির জোগান এবং সিআইপিএস ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ।

দুই দেশের বাণিজ্য ভারসাম্যে বাংলাদেশ বিপুলভাবে পিছিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি ২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবে চীনে মজুরি বাড়ার কারণে শ্রমঘন শিল্প, যেমন তৈরি পোশাক কারখানাগুলো বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদি আমরা সরাসরি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরএমবিকে গ্রহণ করতে পারি, তাহলে এটি সহজ হতে পারে। বিনিয়োগ বাড়লে তারল্যও বাড়বে।

চীনা অর্থনীতি এখন আরও বেশি বাইরে আসতে চাইছে, বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের জন্য উদারনীতি গ্রহণ করেছে। ২০১৫ সালে আরএমবিকে এসডিআর বাস্কেটে যুক্ত করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এর মধ্য দিয়ে আরএমবির আন্তর্জাতিকীকরণের পথে এগিয়ে গেছে চীন। টাকা-আরএমবি বিনিময় ব্যবস্থা চালু হলে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে রুবল, রুপি নয়, বরং ডলারের বিকল্প মুদ্রা হয়ে উঠবে আরএমবি। চীনের এ বদলে যাওয়া আশীর্বাদ হয়ে আসতে পারে বাংলাদেশের জন্য।

বাংলাদেশের সঙ্গে লেনদেনে আরএমবি প্রচলনের চীনা প্রস্তাব ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের উচ্চমধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য পূরণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা যথেষ্ট। সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে।

খায়রুল আলম চৌধুরী
ইভিপি অ্যান্ড হেড অব ট্রেড ফাইন্যান্স অপারেশন
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক