ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক: ভিয়েতনাম কেন শূন্য শুল্ক দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে, বাংলাদেশের গরজ কতটা

ট্রাম্পের শুল্ক মোকাবিলায় ভিয়েতনাম এত ছাড় দিচ্ছে কেনগ্রাফিক্স: প্রথম আলো

বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে কোন দেশগুলো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর হলো, রপ্তানি-নির্ভর দেশগুলো। এ পরিস্থিতি যে সৃষ্টি হবে, চীন অনেক আগেই তা অনুমান করতে পেরেছিল। সে কারণে তারা অভ্যন্তরীণ ভোগ বৃদ্ধিতে জোর দিয়ে আসছে এক দশকের বেশি সময় ধরে।

সেদিক থেকে বাংলাদেশ একধরনের সুবিধাজনক পর্যায়ে আছে। বাস্তবতা হলো, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পণ্য ও বাণিজ্যিক সেবা রপ্তানির শতকরা হিসাবে গত কয়েক বছর স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের সারিতে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩০তম। ২০১০ সালের পর আমরা মাত্র এক ধাপ এগিয়েছি।

ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ অনুসারে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি জিডিপির অনুপাত ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি সত্ত্বেও ২০১০ সালের পর এই অনুপাত কমেছে। জিডিপিতে বাণিজ্যিক পরিষেবা রপ্তানির হিস্যা শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ হলেও পণ্য রপ্তানি ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে কমে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে।

গত ৯ জুলাই ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্কযুদ্ধের বিরতির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এর মধ্যে মাত্র তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাঠামোগত চুক্তি করতে পেরেছে; বাংলাদেশ পারেনি। ফলে গত সোমবার ট্রাম্প যে কয়টি দেশের শুল্ক পুনর্নির্ধারণ করে চিঠি দিয়েছেন, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। শুল্ক নির্ধারিত হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এতে বাংলাদেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াল, তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা।

বিশেষ করে ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। তারা কেন চুক্তি করতে পারল, বাংলাদেশ কেন পারল না। বাস্তবতা হলো, ভিয়েতনামের রপ্তানি বছরে ৪০০ বিলিয়ন বা ৪০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। আমরা রপ্তানি করি মাত্র ৪৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের। ভিয়েতনাম কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই রপ্তানি করে ১১০ বিলিয়ন বা প্রায় ১১ হাজার কোটি ডলারের। এটি মোট রপ্তানির প্রায় ৩০ শতাংশ। আমাদের মাত্র ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলারের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে যায়। যা মোট রপ্তানির ১৭ শতাংশ। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার আর রপ্তানি ভিয়েতনামের জন্য মহা গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিস্থিতিতে তারা শূন্য শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাজারে ঢোকার অনুমতি দিয়েছে। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছে ২০ শতাংশ। যে বাস্তবতার সঙ্গে বাংলাদেশের পুরোপুরি মিল নেই, যদিও রপ্তানি কমে গেলে অর্থনীতি ধাক্কা খাবে, তা নিশ্চিত।

ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ অনুসারে, ভিয়েতনামের জিডিপি রপ্তানির অনুপাত প্রায় ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ জিডিপির প্রায় ৯০ শতাংশই আসছে রপ্তানি থেকে। এ অনুপাত অনেক বেশি। ফলে রপ্তানির বাজার তাদের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদের কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের জিডিপি বা অর্থনীতি রপ্তানি দিয়ে চলে না; বরং আমাদের আমদানি বেশি। অর্থনীতিতে উৎপাদন খাতের চেয়ে সেবা খাতের অবদান বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিসেবা রপ্তানির মতো জটিল পর্যায়ে উন্নীত হয়নি।

অর্থনৈতিক যুক্তি থেকে দেখা যাচ্ছে, এ চুক্তি করতে ভিয়েতনামের যতটা গরজ, বাংলাদেশের গরজ ততটা হবে না। সে কারণে ভিয়েতনাম অনেক আগে থেকেই এ বিষয়ে তৎপর। বাংলাদেশ বরং গত ২ এপ্রিলের পর তৎপর হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় ঘাটতি ছিল।

রপ্তানি খাতের অবদান একটি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। তবে রপ্তানি খাতের অবদান কত থাকা উচিত—এই প্রশ্নের নির্দিষ্ট একক বা সর্বজনীন মান নেই। এটি নির্ভর করে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো, উৎপাদন ক্ষমতা, বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের ওপর।

ভিয়েতনামের অর্থনীতি মূলত রপ্তানি–নির্ভর
রয়টার্স।

রপ্তানিভিত্তিক প্রবৃদ্ধির মডেলের তত্ত্ব অনুযায়ী, রপ্তানির মাধ্যমে একটি দেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো এই মডেল অনুসরণ করে সফলতা পেয়েছে। এই মডেলে রপ্তানি খাতের অবদান বেশি হওয়াকে ইতিবাচক মনে করা হয়।

বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে রপ্তানি-নির্ভর প্রবৃদ্ধিতত্ত্ব যুগান্তকারী কৌশল হিসেবে চিহ্নিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর; পরে চীন ও ভিয়েতনাম এ মডেল অনুসরণ করে দ্রুত শিল্পায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করে। কম মজুরির দেশগুলো বিশ্ববাজারে তাদের শ্রমশক্তি ও উৎপাদনক্ষমতা বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে—এই ছিল এ মডেলের গোড়া। তবে সময়ের পরিক্রমায় অভিজ্ঞতা ও গবেষণায় দেখা যায়, এই সোনালি পথের গভীরে কিছু অন্ধকার গলি আছে; এটি এখন বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।

এ মডেলের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো বৈদেশিক বাজারের ওপর অতিনির্ভরতা। যখন কোনো দেশের প্রবৃদ্ধি একান্তভাবে পশ্চিমা ভোক্তার চাহিদার ওপর নির্ভর করে, তখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেই দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটে চীনের রপ্তানি কমে গিয়ে লাখ লাখ শ্রমিকের চাকরি চলে যায়।

রপ্তানি-নির্ভর প্রবৃদ্ধি একটি কার্যকর কৌশল হলেও তা একক সমাধান নয়। এ মডেলকে দীর্ঘমেয়াদে সফল করতে হলে প্রয়োজন রপ্তানিবৈচিত্র্য, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের প্রসার, অভ্যন্তরীণ বাজারের বিকাশ এবং শ্রমিক অধিকার ও পরিবেশগত অঙ্গীকার। তা না হলে এই মডেল বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যেতে পারে, যেখান থেকে উত্তরণের পথ ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন

চীন কী করেছে

২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর চীন অর্থনীতির কৌশলে মৌলিক পালাবদল ঘটিয়েছে, রপ্তানির জায়গায় অভ্যন্তরীণ ভোগ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিয়েছে। চীনের নীতিনির্ধারকেরা এ কৌশলকে বলছেন ‘ডুয়েল সার্কুলেশন’ বা দ্বৈত প্রবাহনীতি। যেখানে একটি ধারায় থাকবে রপ্তানি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ; কিন্তু মূল চালিকা শক্তি হবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা, ভোগ ও প্রযুক্তি।

এ কৌশলের পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। প্রথমত, বিশ্ববাজারের অনিশ্চয়তা, ট্রাম্প প্রশাসনের সময় শুরু হওয়া বাণিজ্যযুদ্ধ এবং পশ্চিমা বিশ্বের চীনের বিকল্প খোঁজার চেষ্টা থেকে এটা স্পষ্ট—চীনের রপ্তানি এককভাবে নির্ভরযোগ্য নয়।

দ্বিতীয়ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান। বর্তমানে চীনে প্রায় ৪০ কোটির বেশি মধ্যবিত্ত আছে, যাদের ভোগসক্ষমতা ও প্রযুক্তিসচেতনতা আছে। এই শ্রেণি চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারকে নতুন দিগন্ত দিয়েছে।

তৃতীয়ত, প্রযুক্তি খাতের উত্থান। হুয়াওয়ে, আলিবাবা ও শাওমির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু উৎপাদন করে না, তারা চীনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিশ্ববাজারেও আধিপত্য বিস্তার করেছে।

চতুর্থত, আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস। অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারিত করে উপকূলীয় শিল্পাঞ্চল ও অভ্যন্তরীণ প্রদেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য হ্রাস।

তবে এ পরিবর্তন সহজ নয়। অভ্যন্তরীণ ভোগ বাড়াতে হলে চাই গৃহস্থালির আয় বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তার উন্নয়ন ও সেবা খাতের সম্প্রসারণ। চীনের মানুষ এখনো তুলনামূলকভাবে সঞ্চয়প্রবণ। তবে চিকিৎসা, শিক্ষা, পেনশন ইত্যাদি নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। তাই রাষ্ট্রকে এখন আয় বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের রপ্তানি মূলত পোশাক খাত নির্ভর।
ছবি: প্রথম আলো

আমাদের করণীয়

দেশের রপ্তানি খাত মূলত পোশাকনির্ভর। অন্য আরও কিছু খাতের বিকাশ ঘটেছে; কিন্তু সেগুলো ঠিক রপ্তানিমুখী হতে পারছে না। বাস্তবতা হলো, এসব খাত দেশের মধ্যে বড় বাজার পেয়ে যাওয়ায় রপ্তানির প্রয়োজনবোধ করছে না। ফলে এসব খাতের মানোন্নয়ন হচ্ছে না। যেমন চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানির সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না গুণগত কারণে। ফলে রপ্তানিমুখী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া অর্থনীতির সক্ষমতা বা জটিলতা বৃদ্ধিতে এর ভূমিকা আছে। উৎপাদনের উচ্চ স্তরে যেতে এর প্রয়োজন রয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য রপ্তানি-নির্ভর প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কেননা অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার ও ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা এখনো সীমিত। রপ্তানির মাধ্যমে বৃহত্তর বৈদেশিক চাহিদা কাজে লাগিয়ে আমরা উৎপাদন বাড়াতে পারি। এতে স্কেল ইকোনমির সুবিধা পাওয়া যায়, দেশের মোট আয়ও বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের মতো রপ্তানিমুখী খাতগুলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখছে। কিন্তু একপেশে রপ্তানি-নির্ভরশীলতা ঝুঁকিপূর্ণ। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, শুল্কযুদ্ধ বা মহামারির মতো বাহ্যিক অভিঘাতে এসব খাত মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। রপ্তানি আয় হঠাৎ কমে গেলে অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য একপক্ষীয় রপ্তানি বা ভোগনির্ভর মডেলের চেয়ে সমন্বিত পন্থাই সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। এ কৌশলে রপ্তানির বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বৈদেশিক বাজারে অবস্থান শক্ত হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় উৎপাদন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও ভোক্তা চাহিদা বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ বাজার ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত করা যাবে।