আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে চারটি অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি আমাদের জন্য ইতিবাচক দিক। এ চারটি অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা; স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত করা; বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের পরিবেশ উন্নত করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা বা জিরো টলারেন্সের ঘোষণা। এসব অগ্রাধিকারকে আমি স্বাগত জানাই। এ ছাড়া রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণে জোর দেওয়া হয়েছে। আসবাব, বহুমুখী পাটজাত পণ্যের কথা বলা হয়েছে। লজিস্টিক খাতকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে। কিন্তু এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়নি। এ খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। সেটিকে উৎসাহিত করতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ থাকা দরকার ছিল।
এদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে বর্তমানে মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি যথোপযুক্ত হয়নি। সাধারণ করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা তো বাড়েনি, বরং বিদ্যমান করদাতাদের উচ্চস্তরের করহার বাড়ানো হয়েছে। সেটি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। করদাতার সংখ্যা না বাড়িয়ে বিদ্যমান করদাতার ওপর করের চাপ বাড়ানোর উদ্যোগ বাস্তবভিত্তিক নয়। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের ওপর ন্যূনতম করের বিধানটি করনীতির পরিপন্থী। করযোগ্য আয়ের ওপর কর প্রযোজ্য হয়। অন্য কোনো তহবিলের ওপর তা প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়।
সাধারণ মানুষের ওপর থেকে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর জন্য বাজেটে আমরা আরও বেশি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আশা করেছিলাম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। এসব উদ্যোগ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যথাযথ কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তাই বাজেট পাসের আগে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে বলে আশা রাখছি।
বাজেটে নতুন অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। অথচ গত মাসেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। তাই বাজেটে মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি কতটা বাস্তবভিত্তিক, সেটি যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ। সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি যেভাবে কমে আসছে, আমরা সেভাবে কমাতে পারছি না। তাই আমরা আশা করেছিলাম বর্তমানে দেশে ১২টির মতো সম্পূরক শুল্কের যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জরুরি কিছু পণ্যে সম্পূরক শুল্ক কমানো হলে তাতে উৎপাদন খরচ কমত। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে কাস্টমসের যেসব পদক্ষেপ রয়েছে, সেগুলোর কয়েকটি বিষয়ে বাজেটে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু সেগুলো কীভাবে ও কবে থেকে বাস্তবায়ন করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেই।
আগামী অর্থবছর থেকে একক কোম্পানি ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। এই পদক্ষেপ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে করপোরেট করকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সহায়তা করবে। সেই সঙ্গে অনেক কোম্পানি কর প্রদানে আগ্রহী হবে। তবে করপোরেট কর কমানোর সঙ্গে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের যে শর্ত যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, সেটি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। কারণ, বাংলাদেশে এখনো ৮০ শতাংশ অর্থনীতি অপ্রাতিষ্ঠানিক। সেখানে এ ধরনের শর্ত পূরণ করা বেশির ভাগ কোম্পানির ক্ষেত্রেই বাস্তবভিত্তিক নয়।
এদিকে, করসংক্রান্ত আপিলের ক্ষেত্রে দাবি করা করের ২০ শতাংশ জমার যে বিধান এত দিন ছিল, সেটিকে বাজেটে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে, একে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার ঢালাও সিদ্ধান্তটি মোটেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমরা এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাই। এ ধরনের উদ্যোগ নিয়মিত করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে। নৈতিকভাবেও এটি গ্রহণযোগ্য নয়। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আমি মনে করি, এ ধরনের সুযোগ যদি দিতেই হয়, তবে সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ করারোপ করতে হবে।
এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় সরকার বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়নই প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া আরেকটি বিষয়ে আমি খুব গুরুত্ব দিতে চাই। সেটি হলো বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক যে পরিস্থিতি, সেখানে বাজেট বাস্তবায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা বাজেট বাস্তবায়নের মূল্যায়নটা খুবই জরুরি। তিন মাস পরপর এ ধরনের মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সমাজ ও অর্থনীতিতে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো মোকাবিলায় সময়ে সময়ে পদক্ষেপ বা নীতি গ্রহণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। পরিশেষে আমি বলব, অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতাকে মাথায় রেখে বাজেট করার একটি চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী। একই সঙ্গে বলব, নানা খাতে খরচ কমানোর যে চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে যেন মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার