ব্যাংক এশিয়া প্রতিষ্ঠার ২৬ বছর পূর্ণ করেছে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কতটা সফল হয়েছে?
সোহেল আর কে হোসেন: ব্যাংক এশিয়া গত ২৬ বছরে নিয়ম মেনে চলা ও সুশাসিত ব্যাংক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে। বিদেশি সহযোগী ব্যাংক ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে ব্যাংক এশিয়ার সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ়। ফলে ব্যাংকের আর্থিক সূচক, আর্থিক বিবরণীসহ সব ক্ষেত্রেই শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। এ সাফল্যের পেছনে ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তাদের কঠোর পরিশ্রম, দিকনির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সাধারণত ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব থেকে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয়, বিগত বছরগুলোতে ব্যাংক এশিয়া সেসব সমস্যা সফলভাবে এড়িয়ে এসেছে। ব্যাংক এশিয়ার মূল লক্ষ্য হলো একটি স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যাংক গড়ে তোলা, যা শেয়ারমূল্য ও গ্রাহকদের আস্থা দুটোই ধরে রাখবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই কাজ করে যাচ্ছি আমরা।
প্রতিষ্ঠার পর ব্যাংক এশিয়ার সঙ্গে একাধিক ব্যাংক একীভূত হয়েছে। বর্তমানে পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে আপনাদের অভিজ্ঞতা কেমন?
সোহেল আর কে হোসেন: ব্যাংক এশিয়ার কাছে একীভূতকরণের ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে। কানাডাভিত্তিক নোভা স্কোশিয়া ও পাকিস্তানের মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যক্রম অধিগ্রহণ করেছিল ব্যাংক এশিয়া। বর্তমানে পাকিস্তানভিত্তিক ব্যাংক আল-ফালাহর বাংলাদেশের কার্যক্রম অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। আমাদের ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়াগুলো তুলনামূলক সহজ ছিল; সমস্যা ছিল কম। আর বর্তমানে যে পাঁচ ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জ হলো পুনরুদ্ধার। এর মধ্যে আছে পাঁচ ব্যাংকের কর্মী ব্যবস্থাপনা, মন্দ ঋণ, ব্যাংকের মালিকেরা যে অর্থ পাচার করেছেন, তা উদ্ধার করা। এ ছাড়া শেয়ারধারীদের স্বার্থরক্ষা ও শেয়ার একীভূত করার বিষয়ও রয়েছে। তাই পুরো প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল এবং তা সাবধানে সম্পন্ন করতে হবে। এখন সরকার যেহেতু ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব নিয়েছে, তাই দীর্ঘদিন ধরে টাকা ফেরত পাননি—এমন আমানতকারীদের জন্য তা একধরনের সুরক্ষা। এখান থেকে বড় শিক্ষা হলো সুশাসনের দুর্বলতা কীভাবে পুরো খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা বোঝা।
গত ২৬ বছরের ব্যাংকিংয়ে কোন কোন খাতে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে ব্যাংক এশিয়া?
সোহেল আর কে হোসেন: ব্যাংক এশিয়া তার বিস্তৃত এজেন্ট ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক, করপোরেট ও রিটেইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে সারা দেশে ব্যাংক এশিয়ার ১৩৫টি শাখা, ১৫টি উপশাখা, ২১৫টি এটিএম সেবা রয়েছে। আমাদের গ্রাহক ৯০ লাখের বেশি। ব্যাংক এশিয়ার মোট আমানত ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আর ঋণ ২৯ হাজার কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ আছে এবং আর্থিক অনুপাতের সব মানদণ্ডে বজায় রেখেছে। করপোরেট ব্যাংকিংয়ে আমাদের অবস্থান বেশ শক্তিশালী। এ ছাড়া এসএমই খাতে নতুন নতুন ডিজিটাল সমাধান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা চালু করছি আমরা। পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, জ্যেষ্ঠ নাগরিক—এমন বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রাহক অনুসারে আমরা সঞ্চয়, ঋণ, বিমা প্রভৃতি সেবা দিচ্ছি।
ব্যাংক খাতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এর কারণ কী?
সোহেল আর কে হোসেন: গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে গত ১০ বছরে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে করোনা মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধসহ কিছু বহিস্থ প্রভাবও ছিল। এতে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়েছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমেছে, দুবার বৈশ্বিক ঋণমান কমেছে, সার্বিকভাবে আর্থিক খাতের প্রতি মানুষের আস্থাও কমে গেছে। যার প্রভাব আমরা ঋণ বিতরণ থেকে শুরু করে ব্যাংক খাত ও অর্থনীতিতে দেখতে পাচ্ছি। এত কিছুর পরও আশার দিক হচ্ছে আমরা এখন সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে জানি। সমস্যা চিহ্নিত হওয়া পুনরুদ্ধারের প্রথম ধাপ এবং আমরা এখন এই ধাপে আছি। অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে। যদিও ঋণ প্রবৃদ্ধি কম। যার প্রধান কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। বর্তমানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নির্বাচন–পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছেন।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দ্রুত বাড়ছে। আপনার ব্যাংকের অবস্থা কেমন। খেলাপি ঋণ আদায়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছেন?
সোহেল আর কে হোসেন: নতুন হিসাবপদ্ধতি ও পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণের পরিসর বড় হয়েছে। যদিও এর পেছনে গত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতে কিছু খারাপ উদাহরণ, বড় ব্যবসায়ীদের অর্থ পাচার, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি—এসবের বড় প্রভাব আছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হলো আমানতকারীদের টাকা নিরাপদ রাখা এবং গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় সহায়তা করা। খেলাপি ঋণের সমস্যা সমাধানে আমরা একটি পরিকল্পিত পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অনুসরণ করি। সমস্যাগ্রস্ত কোম্পানির আর্থিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে মালিক ও ব্যাংক উভয়ের অংশগ্রহণে তাতে দীর্ঘমেয়াদি পুনঃ অর্থায়ন, নতুন পুঁজি বিনিয়োগ কিংবা ঋণের মেয়াদ সম্প্রসারণের মতো সিদ্ধান্ত নিই। যাতে কোম্পানির ঋণ ও মূলধন আবার স্থিতিশীল পর্যায়ে চলে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ প্রক্রিয়াকে সমর্থন করছে।
বর্তমানে ব্যাংক খাতে নানা ধরনের সংস্কার চলছে। এসব সংস্কারের সুফল কতটা পাওয়া যাবে। আরও কী ধরনের সংস্কার আশা করেন?
সোহেল আর কে হোসেন: বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই ব্যাংক খাতে নানা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার শুরু করেছে। তার কিছু সুফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ সময়ে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ব্যাংক খাতে সুশাসন ও তদারকি ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়া। আমরা সমস্যার প্রকৃতি বোঝার এবং সে অনুযায়ী সঠিক সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। বর্তমানে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৫টি একীভূত করা হচ্ছে। এর বাইরে যেসব ব্যাংকে ভালো সুশাসন রয়েছে, সেগুলোর কার্যক্রম ও অন্যান্য তথ্য বিদেশি ঋণমান সংস্থা, বিদেশি সহযোগী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে, যা বাজার ও গ্রাহকদের আস্থা বাড়াতে সহায়তা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দিচ্ছে। আমরা চাইব, যে ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে ডিজিটাল ব্যাংক কাজ করবে, বিদ্যমান ব্যাংকগুলোও যাতে সেখানে অংশ নিতে পারে। সবার জন্য যেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে।
ব্যাংক এশিয়াকে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা। আপনাদের এ ব্যবসার বর্তমান অবস্থা কী?
সোহেল আর কে হোসেন: আমাদের রয়েছে দেশের বৃহত্তম এজেন্ট ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক। এ নেটওয়ার্কের আওতায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার এজেন্ট আউটলেট ও ৩২ হাজার মাইক্রো এজেন্ট আছে। এর মাধ্যমে আমরা প্রায় ৭০ লাখ গ্রাহককে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে থাকি। এজেন্ট ব্যাংকিং লেনদেনের ৬০ শতাংশ নারী গ্রাহকদের কাছে যায়। আমরা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের সঞ্চয়, ঋণসহ বিভিন্ন আর্থিক সেবা দিয়ে থাকি। বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা আমানত রয়েছে। আর দৈনিক লেনদেন প্রায় ৩০০ কোটি টাকার। তবে আগামী তিন বছরের মধ্যে এজেন্ট, আমানত ও গ্রাহকসংখ্যা তিন গুণ বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি আমরা।
ব্যাংক এশিয়ার ভবিষ্যৎ কৌশলগত লক্ষ্য কী?
সোহেল আর কে হোসেন: গত দুই বছরে আমরা মন্দ ঋণের বিপরীতে রেকর্ড পরিমাণে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশনিং) করেছি। তারপরও ২০২৫ সালের প্রথম ৯ মাসে আমাদের কর–পরবর্তী মুনাফা প্রায় ৭১ শতাংশ বেড়েছে। আমাদের খেলাপি ঋণ এখন উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অন্যদিকে প্রভিশনিং শেষ হওয়ায় ব্যাংকের মূলধনও শক্তিশালী হয়েছে। এ কারণে ব্যাংকের নিজস্ব খরচ কমবে। ফলে সামনের বছরগুলোতে আমরা আরও প্রতিযোগিতামূলক ব্যয়ে গ্রাহকদের ঋণ দিতে পারব। এ ছাড়া সমস্যায় পড়া অনেক প্রতিষ্ঠান আবার ব্যবসা চালু করেছে। এ অবস্থায় ব্যাংক এশিয়া মনে করছে, সঠিকভাবে সহায়তা দিলে খেলাপি হিসাবগুলো থেকেও টাকা ফেরত পাওয়া সম্ভব। তাই আগামী বছরগুলোতে ঋণ আদায়, ঋণ পুনর্গঠন এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।