অর্থনীতির সংকট কতটা পরিসংখ্যানে, কতটা বাস্তবে

জিডিপি লোগো

প্রথম আলোয় গতকাল বুধবার অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। একটি প্রথম পাতার প্রধান প্রতিবেদন। যার শিরোনাম ‘রোজার পণ্য জাহাজে আটকা’। অন্যটি অর্থ–বাণিজ্য পাতায়। যার শিরোনাম ‘২০৪০ সালে অর্থনীতি হবে এক লাখ কোটি ডলারের’। দুটি প্রতিবেদনেই যথেষ্ট তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে।

এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ডলারের অভাবে আমদানি করা পণ্য জাহাজ থেকে খালাস করা যাচ্ছে না। ফলে এসব জাহাজ পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অপেক্ষায় রয়েছে। আর এ অপেক্ষার জন্য আমদানিকারকদের প্রতিদিন গুনতে হচ্ছে লাখ লাখ ডলার। আমদানিকারকেরা বলছেন, পণ্য আমদানির বিপরীতে তারা টাকা পরিশোধ করে দিয়েছেন ব্যাংকে।

কিন্তু ব্যাংক রপ্তানিকারককে ডলারে সেই দাম পরিশোধ করেনি। ফলে জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের অনুমতি দিচ্ছে না রপ্তানিকারক। রোজার চাহিদা মেটাতে আগেভাগে এসব পণ্য আমদানি করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে মঙ্গলবারের একনেক সভায় দেশের অর্থনীতির হালনাগাদ এক প্রতিবেদন তুলে ধরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। সেখানে বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়েছে, গত ছয় বছরে দেশের অর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।

এ প্রবৃদ্ধি যদি কমে ৫ শতাংশের নিচে নেমে যায়, তাহলেও ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার দাঁড়াবে এক লাখ কোটি ডলারে। একনেক সভা শেষে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘বিশ্বে যতই মন্দার পূর্বাভাস দেওয়া হোক না কেন, সেই ঢেউ আমাদের ওপর খুব একটা লাগবে না। বাংলাদেশ মন্দায় পড়ার শঙ্কায় থাকা দেশগুলোর তালিকায় নেই। দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচক ভালো অবস্থায় আছে।’

দুটি প্রতিবেদনের তথ্য–উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কম। তার মানে দুটি প্রতিবেদনই তথ্য–উপাত্তে ঠাসা। দুটিই বাস্তব। তাই পাঠক হিসেবে প্রতিবেদন দুটি পড়ে মনে প্রশ্ন জাগল, সত্য কোনটা। কোনটাকেই বা বিশ্বাস করি। পাঠক হিসেবে এ প্রশ্ন উত্তর নিজেকে নিজের মতোই খুঁজে নিতে হলো। আসলে দেশের অর্থনীতির সংকট যতটা না কাগজে, তার চেয়ে ঢের বেশি বাস্তবে।

অর্থাৎ ব্যবসায়ী হোক বা সাধারণ মানুষ যাঁরা ব্যবসা করছেন, আর যাঁরা পণ্য কিনছেন, প্রতিদিনই তাঁরা নানা সংকটের উত্তাপ টের পাচ্ছেন। এই উত্তাপ অবশ্য সরকারি নথিপত্রে পাওয়া যায় না। এ কারণে সরকারি তথ্যে প্রবাসী আয়–রপ্তানি আয় সবই ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু বাস্তবে ডলারের জন্য হাহাকার। এ কারণে বিদেশ থেকে পণ্য কিনে দায় শোধ করতে পারছেন না আমদানিকারকেরা।

আরও পড়ুন

আবার সাধারণ মানুষ যাঁদের সন্তানের পড়ালেখা বা চিকিৎসার জন্য কালেভদ্রে যৎসামান্য ডলারের প্রয়োজন হয়, তাঁরাও ব্যাংকে ব্যাংকে ধরনা দিয়ে ডলার পাচ্ছেন না। তাই মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন করাই যায়, প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের বাড়ছে, তাহলে সেসব ডলার যাচ্ছে কোথায়?

এবার আসা যাক, পরিসংখ্যান বা তথ্য–উপাত্তের বিষয়টিতে। যেখানে লুকিয়ে থাকে সত্য–মিথ্যা বা বিশ্বাসযোগ্যতা। পরিসংখ্যান অনেক ক্ষেত্রে সংখ্যা বা উপস্থাপনার খেলা। অনেকটা অর্ধেক গ্লাসভর্তি পানির গল্পের মতো। আপনি বা আমি চাইলে, গ্লাসটিকে অর্ধেক পূর্ণও ভাবতে পারি। আবার চাইলে অর্ধেক খালিও ভাবতে পারি। কে কোনটা ভাববেন, সেটা যার যার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করবে। কথা হচ্ছে, গ্লাস পানিতে অর্ধেক ভর্তি বা অর্ধেক খালি যা–ই থাকুক না কেন, ওই পানি যদি কারও পিপাসা মেটাতে না পারে, তাহলে অর্ধেক গ্লাস ভর্তি পানিও শুধু উদাহরণই মাত্র। তেমনি পরিসংখ্যানও।

সরকারি পরিসংখ্যানে অর্থনীতির সব সূচকই ভালো। কিন্তু মানুষ কষ্টে আছে। বাজারে গেলে জিনিসপত্রে দামে অসহনীয় অবস্থা। ব্যাংকে টাকা রেখে মিলছে না সুদ। আমানতের বিপরীতে যেটুকু সুদ দেওয়া হচ্ছে, তা খেয়ে ফেলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরাও বলছেন নানা সংকটের কথা। তাহলে ভালো সূচকের সুফলটা পাচ্ছেন কারা? নাকি পরিসংখ্যানেই গলদ।

অবশ্য সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের বিশ্বাসেও চিড় ধরেছে। কারণ, মানুষ দেখছে সরকারি পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে এক, বাস্তবতা আরেক। অর্থনীতির ক্ষেত্রে তথ্য–উপাত্তভিত্তিক পরিসংখ্যানের চেয়ে মানুষের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা থাকে ভিন্ন।

এ কারণে মাথাপিছু আয় বাড়লেও তার প্রতিফলন বাস্তবে মেলেনি। এখানে পরিসংখ্যান নিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েনের একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। এ সাহিত্যিক বলেছেন, এ জগতে তিন ধরনের মিথ্যা আছে, সেগুলো হলো—‘মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা ও পরিসংখ্যান’।