খালেদা জিয়ার আমলে অর্থনৈতিক সংস্কার, যেসব কারণে স্মরণ করা হবে তাঁকে
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘ ও আলোচিত এক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। তাঁর নেতৃত্বে দেশে যে সংস্কারের ধারা শুরু হয়, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলোর একটি হচ্ছে সংস্কার। দেশের বাস্তবতায় এটি সব সময়ই সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। ১৯৯০ সালের গণ–আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যায়। এ সময় দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সূত্রপাত হয়। পরবর্তী সব সরকারই সেই ধারাবাহিকতা কিছুটা হলেও বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।
খালেদা জিয়ার শাসনামলে অর্থনৈতিক সংস্কারে নেতৃত্ব দিয়েছেন তখনকার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি তাঁকে সংস্কারের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরে এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এম সাইফুর রহমান ১৯৯১ সালে যখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন, তখন এরশাদের মাত্রই পতন হয়েছে। অনেকে বলে থাকেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে এরশাদের দশক ছিল অন্ধকারের দশক। শেষ দিকে এসে দাতাদের চাপে পড়ে সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তখন তা শেষ হয়নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে করব্যবস্থা ও আর্থিক খাতের সংস্কার।
দায়িত্ব নেওয়ার পর সাইফুর রহমান অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার শুরু করেন। মনে রাখা দরকার, তখন ভারতের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন মনমোহন সিং। এ অঞ্চলে সংস্কারের সূত্রপাত মূলত তাঁর হাত ধরে। বিশ্বজুড়ে তখন সংস্কারের হাওয়া লেগেছে। বিশেষ করে বাণিজ্যব্যবস্থা উদার করার ক্ষেত্রে। এম সাইফুর রহমানও সেই পথে পা বাড়িয়েছিলেন। কেননা তখন অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সংস্কারের বিকল্প ছিল না।
খালেদা সরকার দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৯১ সালে নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করা হয়। এর মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ব্যক্তি খাতের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটে, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে। কোনো প্রকার বাধানিষেধ ছাড়াই শতভাগ বিদেশি মালিকানা ও যৌথ বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া হয়। দেশে যে ব্যক্তি খাতের সম্প্রসারণ ঘটেছে বা অর্থনীতি ব্যক্তি খাত নির্ভর হয়ে উঠেছে, সে ক্ষেত্রে এই নীতির বিশেষ ভূমিকা আছে। পরবর্তীকালে সব সরকার এই নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।
এ ছাড়া খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে দেশে সামাজিক উন্নয়নের ভিত গড়ে ওঠে। চর জীবিকায়ন কর্মসূচি এবং আশ্রয়ণ ও আবাসন কর্মসূচি দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। সেই সঙ্গে ১৯৯৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। একই বছরে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের স্কুলমুখী করতে ‘শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচি চালু করা হয়। পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকায় মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা হয় এবং দেশব্যাপী ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু হয়।
ভ্যাট আইন
অর্থনীতিতে খালেদা জিয়ার শাসনামলের সবচেয়ে বড় সংস্কার নিঃসন্দেহে ভ্যাট আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। ১৯৯১ সালের এই আইনে দেশে এই প্রথম উৎপাদন ও আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তন করা হয়। এর মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের নতুন দুয়ার উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি, মুক্তবাজার ও বাণিজ্যিক উদারীকরণ নীতিমালার অংশ হিসেবে আমদানি পর্যায়ে ব্যাপক হারে শুল্ক হ্রাস করা হয়।
বাংলাদেশে এখনো কর-জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে। দেশে যত কর সংগ্রহ হয়, তার প্রায় ৭০ শতাংশই পরোক্ষ কর। ভ্যাট হচ্ছে সেই পরোক্ষ কর। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বাজেটে যে বিদেশি সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হারে কমে এসেছে (যদিও গত কয়েক বছরে বিদেশি ঋণ বেড়েছে), তার মূল কারণ এই ভ্যাট। সেই ভ্যাট প্রবর্তন হয় খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে। এই ভ্যাট চালুর পাঁচ বছরের মধ্যে দেশের উন্নয়ন বাজেটে দেশীয় সম্পদের হিস্যা ২১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ শতাংশে দাঁড়ায়। অথচ তখন সব রাজনৈতিক দল এই ভ্যাট আইনের বিরোধিতা করেছিল।
অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য খালেদা জিয়ার আমলের অর্থনৈতিক সংস্কারে আলোকপাত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ইতিহাস থেকে এ ধরনের দুটি পদক্ষেপের কথা স্মরণ করতে পারি, যা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে।’
প্রথমটি হলো ১৯৯১ সালে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং দ্বিতীয়টি ২০০১ সালের পর মুদ্রার নমনীয় বিনিময় হার পদ্ধতি চালু করা। এ দুটি বড় সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে ভিন্ন দুই মেয়াদে।
বাংলাদেশে ভ্যাট প্রবর্তন এবং বৈদেশিক মুদ্রার নমনীয় বিনিময় হার পদ্ধতি চালুর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও এ ধরনের সাহসী পদক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতির বিষয়ে আমরা অনেকেই সংশয়ে ছিলাম। বস্তুত অর্থমন্ত্রী নিজেই প্রস্তাবিত পদক্ষেপের ওপর উন্মুক্ত বিতর্কে আমাদের সঙ্গে অংশ নেন। সাইফুর রহমান শেষ পর্যন্ত এসব সংস্কার নিয়ে এগিয়ে যান। এখন পেছনে ফিরে দেখলে মনে হয়, তিনি সঠিক ছিলেন।’ (‘ব্যবস্থায় সংস্কারের বিকল্প নেই’, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সমকাল, ২৬ জুলাই, ২০২১)।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও লিখেছেন, ‘বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করতে বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণে সাইফুর রহমানের অবদানের মধ্য থেকে ব্যাংকিং সংস্কার কমিটি গঠনের বিষয়টি স্মরণ করা যেতে পারে। বেসরকারি ব্যাংকের করপোরেট সুশাসনের উন্নয়ন এবং রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় জোরদারে ওই কমিটির সুপারিশ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিতাপের বিষয়, সাম্প্রতিক সময়ে (২০২১ সালের কথা বলছেন) ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবার থেকে পরিচালকসংখ্যা বৃদ্ধি এবং মেয়াদের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে আগের অবস্থায় ফেরত নেওয়া হয়েছে।’
২০০১-০৬ সালে নতুন ব্যাংক হয়নি
খালেদা জিয়ার শাসনামলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত নতুন করে বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন না দেওয়া। সাধারণত নতুন সরকার এলেই নতুন ব্যাংক দেওয়া শুরু হয়। দলীয় লোকজনকে ব্যাংকের মালিকানা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতি নয়, বরং রাজনৈতিক বিবেচনাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে নতুন ব্যাংক নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তখন সমীক্ষা চালিয়ে বলেছিল, দেশের অর্থনীতির যে আকার, তাতে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। যেসব ব্যাংক আছে, সেগুলোকেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানের নীতিমালায় এনে পরিচালনা করা কঠিন চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেই মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে এম সাইফুর রহমান বেসরকারি খাতে আর কোনো নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রাজনৈতিক চাপ থাকলেও তা তিনি প্রতিহত করেছিলেন। বিএনপি সরকারের ওই পাঁচ বছরে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষার কর্মসূচিও তাঁর সময়ে শুরু হয়েছিল।
বেসরকারি বিনিয়োগবান্ধব নীতি ও কৌশলের কারণে শিল্প খাতে যে অগ্রগতি অর্জিত হয়, তার ফলে ২০০৫ সালে গোল্ডম্যান-স্যাকস বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুত উদীয়মান ১১টি দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এ তালিকায় ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের মতো দেশও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কিন্তু একই সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ টানা পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। অর্থাৎ দুর্নীতি দমনে শক্ত ভূমিকা ছিল না।
সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা দরকার ছিল, সেই পরিমাণ বিনিয়োগ হয়নি। বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতে। ফলে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনে কুইক রেন্টালসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়। তাতে আবার দুর্নীতির নতুন দুয়ার উন্মুক্ত হয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়ার শাসনামলে অর্থাৎ যখন সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেশ কিছু উদারীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শুল্ককাঠামো যৌক্তিকীকরণ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বায়নপ্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ শক্তিশালীভাবে অংশ নেয়। এসব উদ্যোগের সুফল পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পাওয়া গেছে। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগও তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল, যদিও শেষ দিকে তারা কিছুটা প্রতিরক্ষণমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, সেই সঙ্গে রপ্তানি খাতে প্রণোদনা কমানো শুরু হয় সাইফুর রহমানের আমলে। একসময় রপ্তানি প্রণোদনা ছিল ২৫ শতাংশ। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়তে শুরু করলে সাইফুর রহমান তা কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে তা কমানো হয়। এখন তা ৪-৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
তখন ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব ছিল। খেলাপি ঋণের অবস্থা এত খারাপ ছিল না। অর্থাৎ এই খাতে বিশৃঙ্খলা হলে তার প্রভাব যে রাজনীতিতে পড়বে, সে বিষয়ে অনুধাবন ছিল বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান।
সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে নিয়মকানুনের বালাই তেমন একটা নেই। সেই সঙ্গে সুশাসনের ঘাটতি প্রকট। এর মধ্যে যতটুকু সংস্কার হয়েছে, তার বড় অংশের সূত্রপাত ১৯৯১–পরবর্তী সময়ে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই সংস্কারের বড় অংশের কৃতিত্ব খালেদা জিয়া সরকারের।