অগ্রাধিকার নির্ধারণ ঠিক হয়নি

মাহতাব উদ্দিন: প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রিসার্চ ফেলো, সানেম
মাহতাব উদ্দিন: প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রিসার্চ ফেলো, সানেম

২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষাপটে বিন্যাসিত দাবি করা হলেও বাজেটের আকার ও পর্যালোচনা এ দাবির অসারতা তুলে ধরে।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় এমন অনেক কর্মসূচি আছে (যেমন গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন), যেগুলো ঠিক সামাজিক নিরাপত্তার মধ্যে পড়ে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরের সামাজিক নিরাপত্তা খাতের খরচ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পুরো বাজেটের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ খরচ হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তার অন্তর্ভুক্ত—প্রকৃত অর্থে সামাজিক নিরাপত্তা নয়—এরূপ কর্মসূচিতে। শুধু ৬ লাখ ৩০ হাজার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার পেছনে ব্যয় ছিল মোট বরাদ্দের প্রায় ৩০ শতাংশ।

এবার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট বরাদ্দ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। কিন্তু আগের বছরের মতো মোট বরাদ্দের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এ বছরও খরচ হবে সরকারি কর্মকর্তাদের অবসর ভাতায়। এ ছাড়া বর্তমান অর্থবছরের বাজেট পরিকল্পনায় আরও কিছু ক্ষেত্র যোগ করা হয়েছে, যেগুলো কোনোভাবেই সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় পড়ে না। যেমন, সঞ্চয়পত্রের সুদ ব্যয়, যেখানে বর্ধিত বরাদ্দের প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে।

দাবি করা হয়েছে, ১০০টি দারিদ্র্যপ্রবণ উপজেলায় ১০ লাখ ৭০ হাজার অতিরিক্ত উপকারভোগীকে এই বছর সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনা হবে (৫ লাখ বয়স্ক ভাতা, সাড়ে তিন লাখ দুস্থ ও বিধবা ভাতা এবং আড়াই লাখ প্রতিবন্ধী ভাতা)। এই তিন কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর বৃদ্ধির সংখ্যা আদতে বিগত অর্থবছরের তুলনায়ও কম। যেখানে বিভিন্ন গবেষণা দেখাচ্ছে, দারিদ্র্যের হার দেশে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে, সেখানে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের এই বাজেট ‘কোভিড-১৯’ প্রেক্ষাপটকে স্বীকার করে বলে প্রতীয়মান হয় না। উপকারভোগীর সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিত ছিল।

কোভিড-১৯ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার সামাজিক সুরক্ষা খাতের অনেক কর্মসূচি মূল হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করতে পারত। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যে ১২৫টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ছিল, তার মধ্যে প্রায় ২০টি কর্মসূচি সরাসরি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান-সংশ্লিষ্ট। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব কর্মসূচিকে আরও জোরদার করা প্রয়োজন ছিল। কোভিড-উত্তর অর্থনীতিতে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এসব কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সামাজিক নিরাপত্তা বাজেটের আওতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের মাসিক বৃত্তি। সানেমের গবেষণায় দেখেছি, বাংলাদেশের যে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনায় আছে, কোভিড-১৯-উত্তর আর্থিক প্রতিকূলতার কারণে তাদের প্রায় ৪৪ শতাংশের পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। গবেষণার আলোকে পরিষ্কারভাবে বলা যায়, এ ধরনের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন আর্থসামাজিক সমস্যার পুনরাবির্ভাব ঘটে। যেমন: শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হার, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম প্রভৃতি ব্যাপক হারে বেড়ে যেতে পারে। এই চার কোটি শিক্ষার্থীর মাত্র ১ শতাংশও যদি শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে, তার পরিমাণ হবে চার লক্ষাধিক। বাজেটের বিশ্লেষণে এসব সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চোখে পড়ে না।

এ অবস্থায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের মাসিক উপবৃত্তির হার (বর্তমানে ১০০ টাকা) বাড়ানো যেত। এরই সঙ্গে ‘স্কুল-খাবার-কর্মসূচি’ দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকাগুলোয় চালু করার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে ১০ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী আছে, তাদের জন্য অধিকতর শিক্ষাবৃত্তির সুযোগ অথবা শিক্ষাঋণের (অত্যন্ত সহজ শর্তে, কম সুদে) উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল।

উপরিউক্ত প্রতিটি কর্মসূচির সম্মিলিত প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারত। এ মুহূর্তে একটি বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর হাতে টাকা নেই। এরূপ কর্মসূচি তাদের হাতে কিছু টাকা দিতে পারত। এতে দারিদ্র্যের হার ও আয়–বৈষম্য হয়তো কমত না, তবে পরিস্থিতির অবনতি রোধ করা যেত। দিন শেষে তাই প্রশ্ন থেকে যায়, এই বাজেটে আমরা কি অগ্রাধিকারের সঠিক প্রতিফলন পেয়েছি?

মাহতাব উদ্দিন: প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রিসার্চ ফেলো, সানেম