অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ হলেই ঠিক হয়ে যাবে

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আমানতকারীদের স্বার্থ দেখা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল দায়িত্ব হলেও লুটপাটকারী ও ঋণখেলাপিদেরই বেশি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকের শাখা যত বাড়ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের সংখ্যা তত কমছে। এসব নিয়ে মতামত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। অনুলিখন করেছেন সানাউল্লাহ সাকিব

সালেহউদ্দিন আহমেদ
সাবেক গভর্নর

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে অনিয়ম-জালিয়াতি অনেক দিন ধরে চলছে। ব্যাংকিং নিয়মনীতি না মেনে বিভিন্ন মহলের নির্দেশ অনুযায়ী ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এতে ঋণখেলাপি বাড়ছে। ব্যাংকিং আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নির্দেশনা উপেক্ষা করেও ঋণ বিতরণের ঘটনা ঘটছে অহরহ।

টিআইবি গত মঙ্গলবার ব্যাংক খাত নিয়ে যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে বলা হয়েছে, ব্যাংকের বিভিন্ন আইনকানুন দুর্বল। সরকার ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে সেটি আগের চেয়ে আরও দুর্বল করে ফেলছে। একই পরিবার থেকে চারজন ও টানা তিন মেয়াদে পরিচালক থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে আমি মনে করি না ব্যাংকের আইনকানুন খুব বেশি দুর্বল। আমি মনে করি, আইনে বাংলাদেশ ব্যাংককে যথেষ্ট স্বাধীনতা ও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সমস্যা হলো ক্ষেত্রবিশেষে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে না বা প্রয়োগ করতে দেওয়া হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা গেলে ব্যাংক খাতের সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোও নির্দেশিত হয়ে ঋণ না দিলে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আর খারাপ হবে না। তাহলেই ব্যাংক খাত আগের মতো ভালো অবস্থায় ফিরে আসবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করায় ব্যাংক খাত ঠিক করার প্রধান শর্ত।

ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে একই পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যা বাড়ানো ও তাদের পদে থাকার মেয়াদও বাড়ানোর ব্যবস্থাটি একেবারেই ঠিক হয়নি। এর মাধ্যমে ব্যাংক খাত উল্টো পথে যাত্রা করেছে। সংস্কারের পরিবর্তে আরও সমস্যা বাড়ানো হয়েছে। এসব সুবিধা বাতিল করে আইনটিকে যুগোপযোগী করা দরকার। প্রয়োজন হলে আপাতত অধ্যাদেশের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে এসব সুবিধা বাতিল করতে হবে। ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে আইনে যে সমস্যা আছে, তার সব কটিই এখন বাতিল করা প্রয়োজন।

টিআইবি তাদের প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার কথা উল্লেখ করে বলেছে, একটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে একক ঋণের বৃহত্তম ঋণসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ২০০৭ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সংঘটিত হলেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ধরা পড়ে। এ ঘটনায় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যবস্থাপক প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকলেও পরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হন। পরে ২০২০ সালে জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা উদ্‌ঘাটিত হলে তাঁকে অপসারণের সুপারিশ করা হয়।

আমিও মনে করি, একটু ভেবেচিন্তে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে দেওয়া প্রয়োজন। পেশাদারত্ব দেখে এসব পদে দায়িত্ব দিতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, এটাও একটা বড় সমস্যা। এ কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপও করতে পারছে না। বেসিক ব্যাংকের কোনো উন্নতি হচ্ছে না, জনতা ব্যাংকের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ব্যবসায়ীরা জোর করে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন। এসব বন্ধ করতে হবে। কেস-টু-কেস ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত ভালো ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে হবে। যেভাবে ২ শতাংশ জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার ঢালাও সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা ঠিক হয়নি। এখন আবার খুব সহজে ঋণ অবলোপনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ঋণখেলাপির সংস্কৃতি চলতেই থাকবে। তখন খেলাপিরাই হর্তাকর্তা হয়ে উঠবেন।

ব্যাংক খাতের সার্বিক উন্নয়নে স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠনের কথা অনেক দিন ধরে বলে আসছি। তবে সরকার এদিকে নজর দেবে বলে মনে হয় না। সরকার যদি বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোতে হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে আর ঋণখেলাপিদের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার প্রশ্ন উঠবে না। সরকার যখন হস্তক্ষেপ করে, দুষ্টচক্র তখন সুযোগ নেয়। রাজনৈতিকভাবে যদি ঘোষণা দেওয়া হয়, ব্যাংক খাতে কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না। তাহলে সবাই সতর্ক হয়ে যাবে।