অর্থনীতি আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

এইচ এম শহীদ শামি: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এইচ এম শহীদ শামি: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

করোনাকালীন মহামারি মোকাবিলা করতে গিয়ে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের অর্থনীতির চাকা থেমে গেছে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচকগুলোর অনেকগুলোই ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এমনকি ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাতেও ভালো ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। কিন্তু এবারের মহামারিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতের নতজানু অবস্থা আমাদের জানান দিয়েছে যে টেকসই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ কতটা পিছিয়ে।

দীর্ঘ সময় লকডাউনের প্রভাবে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে রপ্তানি, প্রবাসী আয়, বিনিয়োগ ও রাজস্ব আয়ে ধস নেমেছে। এই ক্রান্তিকালে অর্থমন্ত্রী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন। প্রস্তাবিত বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ, যা বর্তমান বাস্তবতায় অসম্ভব।

 এই সময়ে বিশাল ঘাটতির বাজেটে অর্থসংস্থান একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকেই আসবে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা।

 ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ব্যাংকঋণ ছিল ৮২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা ওই অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ। ব্যাংক খাত থেকে এত পরিমাণ ঋণ আর্থিক খাতকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে। এই অর্থবছরে আয়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, করোনাকালীন দুর্যোগের কারণে তা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব।

 কেননা মহামারির প্রভাবে জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার যদি প্রস্তাবিত আয় সংস্থান করতে না পারে, ঘাটতি বাজেটের কারণে ব্যাংকঋণের দ্বারস্থ হতে হবে, যা বিরাজমান ব্যাংক খাতের অনিয়মকে (উচ্চ খেলাপি ঋণ, দুর্বল সুশাসন, ক্রমবর্ধমান মূলধন ঘাটতি, পরিচালনা অদক্ষতা ইত্যাদি) ভঙ্গুর আর্থিক খাতে পরিণত করবে।

 বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। প্রতিবছর বাজেটের একটা বড় অংশ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের পেছনে খরচ হয়। এ জন্য কম সুদে বৈদেশিক ঋণের জন্য সরকারক কূটনৈতিক তৎপরতা আরও দৃঢভাবে চালাতে হবে। এ ছাড়া বৈদেশিক সাহায্যের দিকে সরকারকে আরও অধিক তৎপর হতে হবে, যা সুপার সাইক্লোন আম্পান ও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

 প্রস্তাবিত বাজেট যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলেই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ, কৃষি খাতে যন্ত্রাংশ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও আমদানিতে কর নমনীয়তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তিশ্রেণির করের ছাড়, পোশাক খাতে সহায়তা চলমান রাখা এবং করপোরেট কর হ্রাস বাজেটের উল্লেখযোগ্য দিক।

 প্রস্তাবিত বাজেটের এডিপিতে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা এবং পরিবার কল্যাণ খাতে যা বরাদ্দ, তা আগের অর্থবছরের সমান। বর্তমান বাস্তবতায় এই খাতগুলোর প্রতি সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।

 চলমান মহামারিতে শিক্ষা খাতের অচলাবস্থার কারণে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সরকার প্রস্তাবিত বাজেটে যে রূপরেখা প্রণয়ন করেছে, তার যথার্থ বাস্তবায়ন এবং অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তা ছাড়া মোবাইল ইন্টারনেট সেবায় অতিরিক্ত ৫ শতাংশ শুল্ক কর প্রান্তিক ও কর্মহীন জনগোষ্ঠীর, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ব্যয়ভার বাড়াবে। এদিকে সরকারকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগ, উৎপাদনশীলতা, বেসরকারি খাতের ঋণ, প্রবাসী আয়, রপ্তানি ও আমদানি খাতে নিম্ন উত্তর প্রবণতা করোনা উত্তর অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। চলমান এই মানবিক বিপর্যয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে পাশ কাটিয়ে দারিদ্র্য, আয়বৈষম্য এবং কর্মসংস্থানের দিকে বিশেষ আলোকপাত করা প্রয়োজন, যা কেবল সম্ভব হবে যথার্থ ও জবাবদিহির মাধ্যমে প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

এইচ এম শহীদ শামি: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়