অর্ধেক মানুষের কাজের সঙ্গে শিক্ষার অমিল

সারা বিশ্বেই নিয়োগদাতাদের অভিযোগ, যোগ্য লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ কাজের জগতের সঙ্গে শিক্ষার জগতের ফারাক চোখে পড়ার মতো।

যথাযথ দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার কারণে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৯ দশমিক ৯ শতাংশকে ঠিকঠাক কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আর দেশের শ্রমশক্তির মাত্র ৬ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত। নারীদের মধ্যে এই হার মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।

অন্যদিকে দেশে ব্যবস্থাপনা ও কারিগরি কাজে নিয়োজিত আছেন, এমন মানুষের সংখ্যা শ্রমশক্তির ৮ দশমিক ৩ শতাংশ, যদিও উচ্চশিক্ষিত কর্মীর অনুপাত এর চেয়ে কম। অর্থাৎ দেশে যাঁরা উচ্চ দক্ষতার কাজ করছেন, তাঁদেরও বড় একটি অংশের যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। আর উচ্চ দক্ষতার কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের সঙ্গে নিম্ন দক্ষতার কর্মীদের মজুরির পার্থক্য অনেক বেশি।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ এমন কাজ করছেন, যার সঙ্গে শিক্ষা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দেশে বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করে ব্যাংকে চাকরি করেন, এমন মানুষ ভূরি ভূরি পাওয়া যায়। তবে এই প্রবণতা কেবল দেশই নয়, সারা বিশ্বেই আছে।

আবার নিয়োগদাতাদের অভিযোগের শেষ নেই, যোগ্য লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ কাজের জগতের সঙ্গে শিক্ষার জগতের ফারাক চোখে পড়ার মতো।

এই বাস্তবতায় ১৩০টি দেশের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে আইএলও জানিয়েছে, বিশ্বের মাত্র অর্ধেক শ্রমশক্তি শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চাকরি করছেন। বাকিরা হয় অতিরিক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে নিম্ন দক্ষতার চাকরি করছেন অথবা যে কাজ করছেন, তার জন্য যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা তাঁদের নেই।

উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে মানুষ সাধারণত শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ করে থাকেন। সেখানে শ্রমশক্তির অন্তত ৬০ ভাগের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। উচ্চমধ্যম ও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে ৫২ ও ৪৩ শতাংশ। আর নিম্ন আয়ের দেশে এই হার মাত্র ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, একটি দেশ যত উন্নত হয়, ততই শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সামঞ্জস্যতার হার বাড়তে থাকে।

সব দেশেই অতিরিক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন এবং নিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ দেখা যায়। তবে সব দেশে একই হারে এঁদের দেখা যায় না, নিম্ন যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ বেশি পাওয়া যায় নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে, যেখানে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে অতিরিক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ বেশি।

উচ্চ ও উচ্চমধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ অতিরিক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন, অর্থাৎ তাঁরা যে কাজ করেন, তার চেয়ে বেশি যোগ্যতা আছে তাঁদের। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই হার দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং নিম্ন আয়ের দেশে তা ১০ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার হার বেশি। স্বাভাবিকভাবে সেখানে অতিরিক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বেশি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত যোগ্যতার ব্যাপারটা সব সময় কম-বেশি থাকবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, অনেক মানুষ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাপ নিতে চান না বা জীবন ও কাজের মধ্যে ভারসাম্যটা জীবনের দিকে বেশি রাখতে চান বা মোদ্দা কথায় নির্ভার জীবন যাপন করতে চান, তাঁরা কম যোগ্যতার চেয়ে কম ভারের চাকরি করতে চান। আবার অনেকে অভিজ্ঞতার অভাবে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভালো চাকরি করতে পারেন না। তবে এঁদের বেলায় অতিরিক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা সাময়িক ব্যাপার।

বাজারের অসম্পূর্ণতার কারণে এটি ঘটলে ব্যাপারটা দীর্ঘমেয়াদি হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ বাজারে চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও যখন উচ্চশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশেও নিম্ন যোগ্যতার সমস্যা আছে। তবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতেই এদের সংখ্যা বেশি-এসব দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মী যোগ্যতার চেয়ে উচ্চতর কাজ করেন। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে এই হার ৪৬ শতাংশ এবং উচ্চ ও মধ্যম আয়ের দেশে তা ২০ শতাংশ। মূলত শিক্ষাজীবনে শিক্ষণ যথাযথভাবে না হওয়া বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে এমনটা ঘটে। আবার কাজের মধ্য দিয়ে অনেকে প্রয়োজনীয় দক্ষতা রপ্ত করে উঠতে পারেন-অভিজ্ঞতা, স্বশিক্ষণ ও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতেও তা হতে পারে।

কাজ ও শিক্ষার সমন্বয়ের প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে শ্রমবাজারের চাহিদার সঠিক সমন্বয়ের ব্যাপারটি নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। শিল্পকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকে শিক্ষার্থীরা ইন্টার্নশিপ করতে পারে। এমনকি সেখানে স্বল্পমেয়াদে প্রশিক্ষণ নিতে পারে। এর মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিল্পের সংযোগ স্থাপন সম্ভব। এ ছাড়া শ্রমঘন শিল্পে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে নতুন নতুন খাতে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে।

বিশ্লেষকেরা বলেন, অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর, উৎপাদন শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার, যান্ত্রিকীকরন ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কেন্দ্র করে কাজের ধরন বদলে যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণভিত্তিক, আন্তব্যক্তিক ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা কর্মসূচির দিকে গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।