অসংগতি ও কৌশলে ভরা বাজেট বরাদ্দ

বাজেট
বাজেট

নিজে যা, তার চেয়ে একটু বেশি বেশি দেখানোর সুযোগ অনেকেই ছাড়েন না। নিজের গুরুত্ব বাড়াতেও এ কাজ কেউ কেউ করেন। দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের বাজেটও এর বাইরে নয়। এবারের নতুন বাজেটে বেশ কিছু খাতে বরাদ্দ একটু বেশি বেশি বা বাড়িয়ে দেখালেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বাজেটে এক খাতের মধ্যে অন্য খাতের প্রকল্প কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেসব খাত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে বরাদ্দ বাড়ানোর চাপ রয়েছে, সেসব খাতেই মূলত বরাদ্দ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি। আর এ কৌশলের কারণেই এবারের বাজেটে সবচেয়ে বড় বরাদ্দের খাত সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী এবং শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত। এমনকি বরাদ্দ তেমন না বাড়িয়েও কৌশল করে স্বাস্থ্যকেও বড় ও অগ্রাধিকার খাত বলা হয়েছে।

বরাদ্দের চালাকি সামাজিক নিরাপত্তায়

বাজেট মূলত সরকারের আয়-ব্যয় পরিকল্পনার দলিল। বাংলাদেশ কল্যাণরাষ্ট্র নয়। তারপরও বাজেটকে একটা মানবিক চেহারা দেওয়ার জন্য ১৯৯৬ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া প্রথম বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ রেখেছিলেন। দেশের বিপুলসংখ্যক দরিদ্র, দুস্থ ও অসহায় মানুষ থাকার কারণে প্রতিবছরই এর বরাদ্দ বেড়েছে। দেশের ২৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ১৪৫টি কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কাজ করছে। এর মাধ্যমে গরিব, বঞ্চিত, বয়স্ক, পিছিয়ে পড়া, কর্মহীন, প্রতিবন্ধী—এ ধরনের জনগোষ্ঠীকে সরকার নগদ ভাতা বা খাদ্যসহায়তা দিয়ে আসছে। করোনাভাইরাসের কারণে বরাদ্দ আরও বাড়াতে এবার নানা মহল থেকে দাবি উঠেছিল।

চলতি অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী বক্তৃতায় বলেছেন। আগের অর্থবছরের তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, এই খাতের বরাদ্দ প্রস্তাবিত বাজেটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ, আর জিডিপির ৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

বিশ্লেষকেরা অবশ্য একে একধরনের ফাঁকিবাজি বলছেন। কেননা, অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশনের টাকাও সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আগামী অর্থবছরে ৬ লাখ ৩০ হাজার পেনশনভোগীর জন্য বরাদ্দ রয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। আর এতেই সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ ফুলেফেঁপে বড় হয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা এবার আরও অবাক হয়েছেন এই খাতের আরেকটি বরাদ্দ ঢুকে যাওয়া দেখে। এবার নতুন করে সঞ্চয়পত্রের সুদের একটি অংশকেও এই খাতে দেখানো হয়েছে। আর এর পরিমাণ ৬ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। ব্যাখ্যাটা হচ্ছে, মানুষ ব্যাংকে আমানত হিসেবে অর্থ না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনলে যে বেশি সুদ পায়, তা বহন করতে হয় সরকারকে। সুতরাং এটা সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অংশ। হিসাব করে এখন দেখা যাচ্ছে, পেনশন ও সঞ্চয়পত্রেই ব্যয় হয়ে যাবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ৩১ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আছে এবং বেসরকারি খাতও যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, সেসব দেশে পেনশন ব্যয়কে এ খাতের মধ্যে দেখানো হয়। আমাদের দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নেই। পুরোটাই সরকারি কর্মচারীদের নিজেদের অর্থ। এ অর্থকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয় দেখানোর মানেই হচ্ছে, মানুষকে তারা বোকা মনে করছে।’

শিক্ষা বাজেটে সূক্ষ্ম কারচুপি

শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে প্রস্তাবিত বাজেটে ৮৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়েছে, যা মোট বাজেটের সম্পদ ব্যবহারের দিক থেকে সর্বোচ্চ, ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসাশিক্ষা বিভাগের বরাদ্দ ৬৬ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। এর বাইরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ১৭ হাজার ৯৪৬ কোটি এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের ১ হাজার ৪১৫ কোটি ঢুকিয়ে শিক্ষা খাতের হিসাবটি বেশ বড় করে দেখানো হয়েছে। এর ফলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ১৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকাও এখন শিক্ষা বাজেটের অংশ হয়ে আছে।

আবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হাওর এলাকায় জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ইমামদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণ প্রকল্পও দেখানো হয়েছে শিক্ষা খাতে। পুরো বিষয়টিতেই শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষা বাজেটের ব্যাপারে বাজেটের যে শিক্ষা পাচ্ছি, এক দশক ধরেই তা ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ১১ দশমিক ৬৮ থেকে বেড়ে এবার হয়েছে বাজেটের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ধরে যে হিসাবটা দেখানো হয়, তা স্রেফ ফাঁকিবাজি।’

স্বাস্থ্য খাতে প্রকৃত বরাদ্দ কত

স্বাস্থ্য খাতে এবারের বরাদ্দের পুরো হিসাবটাই যথেষ্ট গোলমেলে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা। অথচ বাজেট দলিলে দেখা যাচ্ছে, বরাদ্দ ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।

কোভিড-১৯ উপলক্ষে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নের ২ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ব্যয় সমন্বয় করলে দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে এবার সরকারের বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ১ হাজার ২২ কোটি টাকা। বাকি আছে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে জরুরি থোক বরাদ্দ ১০ হাজার কোটি টাকার হিসাব। তবে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় এর উল্লেখ করেছেন ঠিকই, কিন্তু মূল বাজেট দলিলে এ নিয়ে কোনো তথ্য নেই।

এভাবেই এবার বহুল আলোচিত স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশের বেশি আনা হয়েছে। এই খাতের বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশের কম বলে ব্যাপক সমালোচনা ছিল।

যোগাযোগ করলে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং ব্র্যাক স্কুল অব পাবলিক হেলথের প্রতিষ্ঠাতা মোশতাক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশ বরাদ্দের মধ্যে শুভংকরের ফাঁকি আছে। স্বাস্থ্য খাতের গৎবাঁধা বাজেট দেখেই বোঝা গেল, কোভিড-১৯-এর শিক্ষা কোনো কাজে আসেনি।

>নতুন বাজেটে বেশ কয়েকটি খাতে এমনভাবে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, যাতে জিডিপি ও বাজেটের তুলনায় তা বড় দেখায়।

কৃষি ভর্তুকিতে ইশপের গল্প

ইশপের গল্পে এক মুরগি বা এক কুমিরের ছানাকে বারবার দেখানোর একটি ঘটনা ছিল। সেই গল্প যেন ফিরে এসেছে অর্থমন্ত্রীর এবারের বাজেটে। কৃষি খাতের ভর্তুকিকে অর্থমন্ত্রী একাধিক জায়গায় দেখিয়েছেন। আর এই ভর্তুকির পরিমাণ সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। প্রতি অর্থবছরেই কৃষি ভর্তুকি হিসেবে সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকা রাখা হয়, এটি নতুন কোনো বরাদ্দ নয়। আর এবার এই ভর্তুকিকে কোভিড-১৯ মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের তালিকায়ও দেখানো হয়েছে।‌

মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, করোনা-পরবর্তী দেশের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত ও কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। ১৯টি বিষয়ের প্রণোদনা প্যাকেজে মোট বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। আর এই প্রণোদনা প্যাকেজ দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ বলা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় কী বলছে

সব বিষয়ে কথা বলতে গতকাল রোববার সচিবালয়ে অর্থসচিবের কার্যালয়ে গেলে তাঁর একান্ত সচিব মো. হেলালউদ্দিন প্রতিবেদকের কাছে বিষয়বস্তু জানতে চান। প্রতিটি বিষয় আলাদা করে উল্লেখসহ লিখিত প্রশ্ন পাঠালে সচিব ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব দেন অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব সিরাজুন-নূর চৌধুরীকে।

সিরাজুন-নূর প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যের থোক বরাদ্দ থেকে প্রয়োজনে ব্যয় হবে। সুতরাং দেখানোটা ঠিকই আছে। আর পেনশন সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দেখানো হলেও রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য পাঁচ হাজার কোটি দেওয়া হয়েছে, তা-ও একধরনের সামাজিক সুরক্ষা। এমনকি বিদ্যুতে ভর্তুকিও সামাজিক সুরক্ষা। এগুলো কিন্তু দেখানো হয়নি।

সিরাজুন-নূর চৌধুরী বলেন, এটা ঠিক যে প্রতিবারই কৃষি খাতে ভর্তুকি থাকে। কোভিড-১৯ না থাকলেও এ ভর্তুকি থাকতই। এবারের ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে না দেখালেও চলত, আবার দেখানোয়ও কোনো সমস্যা নেই। তিনি বলেন, শিক্ষা ও প্রযুক্তিকে একসঙ্গে যেমন দেখানো হয়েছে, আলাদাও দেখানো হয়েছে। এ হিসাব একেক দেশ একেকভাবে করে।

তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুক্তি নাকচ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দের মধ্যে পেনশন, বৃত্তি, সঞ্চয়পত্রের সুদ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে মূলত এ খাতের বরাদ্দকে বড় করে দেখানোর জন্য। সরকার তা করছে অনেকটা রাজনৈতিক অর্থনীতির যুক্তি থেকেই। নইলে এ খাতের প্রকৃত বরাদ্দটি কম দেখায়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের ক্ষেত্রেও সরকারের একই চিন্তা কাজ করছে। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেহেতু সব সময়ই এসব বিষয়ে বরাদ্দ নিয়ে কথা বলে, কোনোভাবে তাই এগুলোকে ন্যূনতম মান পর্যন্ত দেখাতে চায়। কে জানে, এতে হয়তো মুখ বাঁচে। তবে কৃষি ভর্তুকির টাকাকে কোভিড-১৯-এর প্রণোদনার তালিকায় আবার দেখানো একদমই উচিত হয়নি।