আদায় হচ্ছে না ঋণ, আয়ও কমে গেছে

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

এমনিতেই নাজুক অবস্থায় দেশের ব্যাংক খাত। এর মধ্যে এপ্রিল থেকে সরকারি নির্দেশে ঋণের সুদহার কমিয়ে ৯ শতাংশ করা হয়েছে। পরিচালনাগত ত্রুটি ও নিয়ন্ত্রণ দুর্বলতার কারণে ব্যাংকগুলোতে আগে থেকেই ছিল খেলাপি ঋণের বোঝা। আর এখন ঋণের কিস্তি না দিলেও খেলাপি না করার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

করোনাভাইরাসের কারণে দুই মাসের সুদ আয় স্থগিত করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়ায় ব্যাংকের কমিশনও কমে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোর আয় যেমন হ্রাস পাচ্ছে, তেমনি ঋণ আদায়ও ব্যাপক কমে গেছে।

আবার মহামারির এই সময়ে ব্যাংকগুলোতে আমানত উত্তোলনের চাপ রয়েছে, নতুন আমানত নেই বললেই চলে। ফলে তারল্যসংকটের আশঙ্কা আছে।

এ রকম অবস্থায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ব্যাংকগুলোকেই মূলত প্রধান দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যদিও ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিয়ে ঋণ দিতে আগ্রহী নয়, এ জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম দাবি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। তারা কী পাবে, কী পাবে না—সবই জানা যাবে এক দিন পর। কাল বৃহস্পতিবার নতুন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সুদের হার কমানোয় ব্যাংকগুলোর আয় কমে গেছে। আবার দুই মাসের সুদ স্থগিতে আয়ে বড় ধাক্কা এসেছে। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসাও মন্দা। ফলে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোর আয় কমে যাবে। টিকে থাকতে ব্যাংকগুলো খরচ কমানো শুরু করেছে, ভাড়া ও পরিচালন খরচ কমাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

ব্যাংকের আয় কমছে

বাংলাদেশ ব্যাংক গত এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণে ৯ শতাংশ সুদ আরোপের নির্দেশ দেয়। একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, এর ফলে চলতি বছরে ব্যাংকগুলোর ১৫ হাজার কোটি টাকা আয় কমে যাবে। আবার এপ্রিল ও মে মাসের সুদকে আয় খাতে না নিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ১৬ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা সুদ আপাতত আয় খাতে নেওয়া বন্ধ রয়েছে। সরকার এই সুদ ভর্তুকি হিসেবে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু বাকি সুদ কে বহন করবে, গ্রাহক না ব্যাংক, সেই সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, ব্যাংককে কিছুটা ছাড় দিতে হবে, বাকিটা গ্রাহকদের। এ দুই সিদ্ধান্তেই ব্যাংকগুলো প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা আয় হারাবে।

আবার ব্যাংকের আয়ের বড় অংশ আসে কমিশন ব্যবসা। আমদানি যেমন কমেছে, নতুন ঋণপত্র খোলাও কমেছে ২৫০ শতাংশের বেশি। আবার রপ্তানিও কমেছে ৮০ শতাংশের। ফলে ব্যাংকগুলো আমদানি-রপ্তানি থেকে যে মাশুল পায়, তাতে বড় আঘাত এসেছে।

>

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রধান দায়িত্ব ব্যাংকের। তবে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিয়ে কম সুদে ঋণ দিতে খুব আগ্রহী নয়।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সুদহার কমায় অনেক ব্যাংকের লোকসান হবে। তিনি আশা করেন, সরকার প্রণোদনা দেওয়ায় ব্যাংকের আমানত বাড়বে। কারণ, টাকা ঘুরেফিরে ব্যাংকেই আসবে। করোনার প্রণোদনা দেওয়ায় আমেরিকায় ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়েছে।

ঋণ আদায় নেই, আমানতও কমছে

করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দেয়, জুন পর্যন্ত ঋণের কিস্তি আদায় না হলেও কাউকে খেলাপি করা যাবে না। এরপরই ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কমে গেছে। যদিও বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করার পরও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।

ঋণ আদায় কমায় ব্যাংকের টাকা আসার প্রবাহ কমে গেছে। আগের চেয়ে টাকা উত্তোলন বেড়েছে। নতুন করে আমানতও গ্রাহকেরা রাখছেন না। এ অবস্থায় তারল্যসংকট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা নীতিসহায়তা দিয়েছে। ঋণ আমানত অনুপাতের সীমা বাড়িয়েছে, নগদ জমার হার (সিআরআর) ও সংবিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) কমিয়েছে। ৩৬০ দিন মেয়াদে টাকা ধার-সুবিধাও চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এখন বিদেশি উৎস থেকে ডলার লোন নিয়ে টাকা ও ডলারের তারল্যসংকট মেটাতে পারে। ব্যাংকগুলোর মুনাফা এভাবে কমে গেলে শেয়ারবাজারে প্রভাব পড়বে, ভীতি বাড়বে আমানতকারী ও ব্যাংকের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে বড় উদ্বেগ প্রকাশ করছে বিদেশিরা। খেলাপি ঋণে জর্জরিত দেশে জুন পর্যন্ত খেলাপি না করার সিদ্ধান্ত একদমই ভালোভাবে নেয়নি। এতে সমস্যা আরও বাড়ল।

আস্থা পাচ্ছে না ব্যাংক

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। আবার তারল্য বাড়াতে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার জোগান দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে করোনায় ক্ষতিতে পড়া ব্যবসায়ীদের ঋণ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা কমেছে বলে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে অনাগ্রহী। এ জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের দাবি তুলেছেন ব্যাংকাররা।

ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ঋণের সুদ ৫ শতাংশের কম হওয়ায় অনেক আবেদন আসছে। তবে অনুমোদন হচ্ছে খুবই কম। বিশেষ করে ভালো ব্যাংকগুলো বেছে বেছে এই কম সুদের ঋণ অনুমোদন করছে। এর ফলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ব্যাহত হয় কি না, সেটাই দেখার বিষয় বলে মনে করের বিশেষজ্ঞরা।