আমাদের অর্থনীতি এখন শামুকের মতো

১৪ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল ‘অর্থনীতির যে ৫ সূচক নিয়ে দুশ্চিন্তা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন। সেই প্রতিবেদন নিয়েই নিজের মতামত জানিয়েছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন

বিনায়ক সেন, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)

স্ট্যাগপ্লেশন তখনই হয়, যখন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি একেবারেই শূন্য বা ঋণাত্মক হয়ে যায়, সঙ্গে থাকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে, বিশেষ করে ভারতে এবার সেই সম্ভাবনা দেখা দিলেও, বাংলাদেশে তা কখনোই দেখা দেয়নি। সব সময়ই একটি ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা ছিল। মূল্যস্ফীতিও ৫ থেকে ৬ শতাংশের বেশি ওঠেনি। সুতরাং স্ট্যাগফ্লেশন এখানে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা নেই।

আর এটা ঠিক যে নতুন দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণার দরকার আছে। বিশেষ করে দারিদ্র্যের হার কমার যেসব তথ্য বলা হচ্ছে, সেগুলো গত বছরের ডিসেম্বর নাগাদ পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে বলা। এরপর তো অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ঘটছে। এটা ঠিক যে নতুন দারিদ্র্য বেড়েছে। কিন্তু কতটা বেড়েছে, সেই হালনাগাদ তথ্য আমরা আসলে জানি না। যাঁরা হিসাব করেছেন, তাঁরা করোনার প্রথম ঢেউয়ের ভিত্তিতেই তা করেছেন। দ্বিতীয় ঢেউ পরবর্তী সময়ের কোনো হিসাব আমরা পাইনি।

আরও পড়ুন

তবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস) ইউএনডিপির সঙ্গে মিলে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে ঢাকার চার হাজার খানার ওপর জরিপ করেছিলাম, সেই একই খানায় আমরা আবার জরিপ করতে যাচ্ছি। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) একটি দ্রুত জরিপ করতে যাচ্ছে বলে জেনেছি। তবে নতুন দারিদ্র্য বৃদ্ধির হার নিয়ে আমি রক্ষণশীল। আমি মনে করি, হার সামান্য বাড়বে, আগে যতটা ভাবা হয়েছিল ততটা নয়।

তবে অর্থনীতির পাঁচটি সূচক নিয়ে যে দুশ্চিন্তার কথা বলা হচ্ছে, আমি এর সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতাকে যুক্ত করতে চাই। আর বৈষম্যকে আমরা আয় ও সম্পদের জায়গা থেকে দেখি। তবে এভাবে দেখাটা এখন আর যথেষ্ট নয়। যে প্রতিক্রিয়াগুলো ব্যক্ত হচ্ছে, তা কেবল আয় ও সম্পদের বৈষম্যের কারণে হচ্ছে, তা বলা যাবে না। এটা বহুমাত্রিক অবস্থান থেকে দেখতে হবে। তরুণদের ক্ষোভের কারণ তো স্পষ্ট। তরুণদের মধ্যে যে প্রত্যাশা আর বাস্তবে তারা যা পাচ্ছে, এর মধ্যে অনেক ফারাক। এটা বিপদ নিয়ে আসবে। এত দিন ভাবনা ছিল যে অদক্ষ শ্রমিক দিয়েই সব সম্ভব হবে। কৃষি, পোশাক খাত, ক্ষুদ্রঋণ—এসব দিয়ে এত দিন মোটামুটি চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সামনে আর তা হবে না। এখনকার তরুণেরা কিন্তু শিক্ষা পাচ্ছে, তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিচ্ছে, তাদের আশা বা প্রত্যাশা উঁচুতে। সে অনুযায়ী কিন্তু তরুণেরা কিছু পাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

আগেই বলেছি, বৈষম্য বহুমাত্রিক জায়গা থেকে দেখতে হবে। এর মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইসের বৈষম্য একটি। করোনার সময় অনলাইনে শিক্ষা নেওয়ার এসব উপকরণ সবার কাছে ছিল না। আবার এ সময় শেখার ঘাটতি হয়েছে, যাকে আমরা ‘লার্নিং লস’ বলছি। এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া কিন্তু আমরা জানি না। অনেকেই অনেক কিছু ভুলে গেছে, অনেকেরই হয়তো পড়ার ওপর থেকে মন উঠে গেছে।

আমার মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের পর টানা এত দিন বসে থাকা তো আর কখনো হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বসে থাকতে হয়েছে, আবার যে ভবিষ্যৎ সে দেখতে চায়, তা পারছে না। এসব কিন্তু বেকারত্বের সূচকে ধরা পড়বে না। কারণ, টিকে থাকার জন্য হয়তো কিছু না কিছু করতে বাধ্য হতে হয়েছে, কিন্তু তাদের প্রত্যাশা আরও বড় কিছু। আমার মনে হয়, দেশের তরুণদের নিয়ে ভালো কিছু গবেষণা হওয়া দরকার। কারণ, তারাই তো সংখ্যায় বেশি। তাদের ওপরই কিন্তু নির্ভর করছে আগামী পাঁচ বছরের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির হালচাল।

সুতরাং নেতৃত্ব এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমস্যা হলো আমলাতন্ত্র দিয়ে রাষ্ট্র চালানো যাবে, সংকট মোকাবিলা করা যাবে, কিন্তু তারা তরুণদের নেতৃত্ব দিতে পারবে না। তরুণদের নেতৃত্ব দিতে হবে রাজনীতিবিদ বা সমাজ সংগঠকদের। তরুণসমাজকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে, তাদের একটি দিশা দেখানোর ক্ষেত্রে একটি বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এ শূন্যতা আগে অগ্রাহ্য, অস্বীকার বা এড়ানো যেত। কিন্তু এখন আর সেটি সম্ভব নয়।

আমাদের অর্থনীতি এখন অনেকটা শামুকের মতো। ওপরের খোলসটা শান্ত, দেখে মনে হয় ঠিকই আছে, কিন্তু একটু ঘষা দিলেই বোঝা যায় ভেতরে কিছু একটা আছে, ফুটন্ত, টগবগ করছে। একটু এদিক-সেদিক হলেই এর নানামুখী প্রকাশ ঘটবে।