আলো-আঁধারে সম্ভাবনার পর্যটন

ভ্রমণের শুরুটা অনেক আগে। সেই আদিকাল থেকেই খাদ্য ও শিকারের সন্ধানে ঘর থেকে বের হয়ে মানুষ আবিষ্কার করে নতুন নতুন এলাকা ও স্থান। এরপর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে অনেক সময় অনেক দূরদেশে পাড়ি দিতে থাকে মানুষ। ঘরবাড়ি ছেড়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকে। যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করে গাড়ি, ট্রেন বা নৌযান। থাকার জন্য বেছে নেয় সরাইখানা, অতিথিশালা কিংবা নিদেনপক্ষে কোনো হোটেল। খাবারের জন্য কোনো রেস্তোরাঁ। ফেরার সময় ওই এলাকা থেকে পরিবার-পরিজনের জন্য কিনে আনে উপহার।

বাসা থেকে বের হয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত একজন মানুষ জড়ায় পর্যটনের নানা খাতে। মানবসভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে পর্যটন। পর্যটনের আছে দীর্ঘ ইতিহাস। আছে নানা চড়াই-উতরাই। অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখা আর অচেনাকে চেনার আকাঙ্ক্ষা থেকেই মানুষ ভ্রমণ করে। এতে আনন্দ আর শিহরণ আছে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, পণ্যের আদান-প্রদান এবং সর্বোপরি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময়ও ভ্রমণ ছাড়া সম্ভব নয়।

তবে ভ্রমণের মাত্রা বেড়ে যায় ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই। এ ছাড়া উনিশ শতকের শুরুতে রেলওয়ে ইঞ্জিন এবং বিশ শতকের প্রথম দশকে অটোমোবাইলের যুগান্তকারী আবিষ্কার ভ্রমণের মাত্রাকে বহুগুণ বাড়াতে সাহায্য করে। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উড়োজাহাজের আবিষ্কার ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভিন্নমাত্রা যোগ করে। বিশ্বজুড়ে পর্যটনশিল্পের বিকাশে মাইলফলক হিসেবে দেখা হয় উড়োজাহাজ আবিষ্কারকে।

বছরের প্রথম ৬ মাসে বেসরকারি বিমান পরিবহনে ৬০০ কোটি টাকা, হোটেল-রিসোর্টে দেড় হাজার কোটি টাকা, ট্রাভেল এজেন্টদের ৩ হাজার কোটি টাকা, ট্যুর অপারেটরদের ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা, রেস্তোরাঁয় ৫০০ কোটি টাকা, পর্যটনে ব্যবহৃত স্থানীয় যানবাহন খাতে ৪০ কোটি ও ভ্রমণতরি খাতে ১৫ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হিসাব করেছে পাটা বাংলাদেশ।

একজন পর্যটক ১০ জনের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেন। ২০১৯ সালে ৩৩ কোটি মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে পর্যটন। ৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে পর্যটনে। বৈশ্বিক জিডিপিতে যার অবদান ১০ শতাংশের বেশি। সংখ্যাগত এসব হিসাব দেশে তেমন একটা পাওয়া যায় না। দেশের পর্যটন খাত নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা নেই। অভিবাসন বিভাগ, পরিসংখ্যান ব্যুরো কিংবা বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন থেকে কিছু হিসাব পায় বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বছরের শুরুতে একটি বার্ষিক পরিকল্পনা তৈরির কথা প্রতিষ্ঠানটির। তবে পরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা থাকেন অবহেলিত। দেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশ চলছে ধীরলয়ে।

জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা বলছে, এ বছর ৩০ থেকে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হতে পারে পর্যটন খাতে। আগের বছরের তুলনায় ২০২০ সালে ৩ থেকে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ছিল সংস্থাটির।

২০১৬ সালের ঘটনা। বনানীর হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা চালিয়ে ইতালীয়, জাপানিসহ দেশি-বিদেশি ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। উন্নত দেশের অনেকেই বাংলাদেশ ভ্রমণে বিভিন্ন মাত্রায় সতর্কতা জারি করে, যার রেশ এখনো পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। তবু ধীরে ধীরে অনেকটা উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু সব তছনছ করে দিল মহামারি করোনাভাইরাস। এখন ধুঁকে ধুঁকে পথ চলছে দেশের পর্যটন খাত।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খাতের মধ্যে অন্যতম পর্যটনশিল্প। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা বলছে, এ বছর ৩০ থেকে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হতে পারে পর্যটন খাতে। আগের বছরের তুলনায় ২০২০ সালে ৩ থেকে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ছিল সংস্থাটির। করোনা শুরুর পর তা সংশোধন করে ১ থেকে ৩ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। পুনরুদ্ধারে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা।

দেশে করোনার প্রভাব নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পাটা) বাংলাদেশ কেন্দ্র। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ের তথ্য সংগ্রহ করে একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছে সংস্থাটি। এতে সামগ্রিক তথ্য না পাওয়া গেলেও সবার কাছে এটি সমাদৃত হয়েছে। এ হিসাব বলছে, জুন পর্যন্ত দেশের পর্যটন খাতে ক্ষতি ৯ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। এতে তিন লাখ কর্মী বেকার হয়ে পড়তে পারেন। বছরের প্রথম ৬ মাসে বেসরকারি বিমান পরিবহনে ৬০০ কোটি টাকা, হোটেল-রিসোর্টে দেড় হাজার কোটি টাকা, ট্রাভেল এজেন্টদের ৩ হাজার কোটি টাকা, ট্যুর অপারেটরদের ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা, রেস্তোরাঁয় ৫০০ কোটি টাকা, পর্যটনে ব্যবহৃত স্থানীয় যানবাহন খাতে ৪০ কোটি ও ভ্রমণতরি খাতে ১৫ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হিসাব করেছে পাটা বাংলাদেশ। এ হিসাবে বছর শেষে এটি ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তবে সেপ্টেম্বর থেকে স্থানীয় পর্যটন চালু হওয়ায় ক্ষতি কিছুটা কমলেও তা তেমন বেশি নয়।

আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটন তেমন উল্লেখ করার মতো নয়। তবে দেশের ভেতরে বছরে প্রায় এক কোটি পর্যটক বেড়াতে যায়। তাদের বেড়ানো থেকে বছরে আয় ২৫০ কোটি টাকার বেশি। লাখ লাখ মানুষ এ খাতের বিভিন্ন পেশায় জড়িত। ছোট উদ্যোগ বড় সংকটের মধ্যে পড়েছে। দেশে করোনা সংক্রমণের প্রায় আট মাস হয়ে গেছে। শীতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা। পরিস্থিতি খারাপ হলে দেশের ভেতর চালু হওয়া পর্যটন কত দিন চালু থাকবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। ছোট এ শিল্প খাতের ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে বিকল্প আয়ের চেষ্টা করছেন। তাঁদের অধিকাংশই বর্তমান অফিস ছেড়ে দিয়ে ছোট অফিসে উঠে এসেছেন।

করোনার ক্ষতি পোষাতে শিল্প ও সেবা খাতে প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেবা খাতের আওতা পর্যটনশিল্পও রয়েছে। তবে বিশেষ বিবেচনায় দু-একটা কোম্পানি ঋণসহায়তা পেলেও বাকিদের কাছে তা অধরাই থাকছে। এ শিল্প বাঁচাতে আলাদা করে তিন হাজার কোটি টাকার সুদমুক্ত সহায়তা দরকার। এ ছাড়া করোনা–পরবর্তী পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার চালাতে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। এ খাতের ব্যবসায়ীদেরও হাল ছাড়া চলবে না। যতটা সম্ভব কর্মী ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। কেউ চাকরি হারালে তাঁকে পুনরায় নিয়োগের আশ্বাস দিয়ে রাখতে হবে। এ খাতে দক্ষ কর্মীর অভাব আছে। কোনোভাবেই কর্মী হারানোর ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।

বিশ্বে পর্যটন হচ্ছে একক বৃহত্তম কর্মসংস্থানভিত্তিক শিল্প। পর্যটন কাজে লাগিয়ে অর্থনীতি সমৃদ্ধ করছে অনেক দেশ। অথচ ব্যাপক সম্ভাবনা থাকার পরও তা কাজে লাগাতে পারছি না আমরা। যথাযথ পরিকল্পনা, সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এগোচ্ছে না দেশের পর্যটন খাত। এমন হতাশাজনক পরিস্থিতি অনেক কষ্টের। করোনা আরও পিছিয়ে দিচ্ছে। আলো-আঁধারের দোলাচলে আছে দেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন। একসময় আবার পৃথিবী স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ভবিষ্যতের জন্য তাই এখনই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। করোনাকালের এ সময়টাকে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা তৈরিতে কাজে লাগানো যেতে পারে।