উন্নয়নে সুশাসন জোর পায়নি

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন সাফল্য তুলে ধরেন। পাশাপাশি বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে যাওয়ার মাধ্যমেও দুর্নীতি হয়।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে আর্থসামাজিক খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও দেশে বৈষম্য বেড়েছে এবং সুশাসনের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন দেশের দুই প্রথিতযশা প্রবীণ অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহান।

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেছেন, দেশে দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বেড়েছে। বৈষম্য বেড়ে গেলে বিদেশে টাকা পাচার বাড়ে। অন্যদিকে অধ্যাপক রেহমান সোবহান মনে করেন, সুশাসনের অভাব আছে বলেই দেশে রানা প্লাজা, তাজরীনের মতো ট্র্যাজেডি হয়েছে। অনেকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হয়েছেন। উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় সুশাসন জোর পায়নি।

নুরুল ইসলাম

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী উন্নয়নবিষয়ক বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গতকাল বুধবার অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এ সময় তাঁরা এসব কথা বলেন।

আয়বৈষম্য বেড়ে গেলে কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচারও বেড়ে যায়। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এখন রাজনৈতিক সমস্যা।
নুরুল ইসলাম, ডেপুটি চেয়ারম্যান, প্রথম পরিকল্পনা কমিশন

অনুষ্ঠানে নুরুল ইসলাম ভিডিও বার্তার মাধ্যমে এবং রেহমান সোবহান অনলাইনে সরাসরি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। রাজধানীর একটি হোটেলে এই সম্মেলন হচ্ছে।

স্বাধীনতার পর পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) ইমেরিটাস ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, সব ধরনের পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫০ বছরে দেশে দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে কমেছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে বৈষম্যও বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এখন রাজনৈতিক সমস্যা।

রেহমান সোবহান

সুশাসন সম্পর্কে নুরুল ইসলাম বলেন, উন্নয়নের যাত্রায় সুশাসন জরুরি। উন্নয়ন ও সুশাসন নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। তিনি দুর্নীতির উদাহরণ দিয়ে বলেন, স্বজনপ্রীতি এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একটি গোষ্ঠীর কাছে কুক্ষিগত হয়ে যাওয়ার মাধ্যমেও দুর্নীতি হয়।

অর্থনীতির ইতিবাচক দিকের কথাও বলেন নুরুল ইসলাম। তাঁর মতে, প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) ও রপ্তানি অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখেছে। প্রবাসী আয় গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন এনেছে। রপ্তানির সাফল্যে এ দেশে উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে উঠেছে।

সুশাসনের অভাব আছে বলেই দেশে রানা প্লাজা, তাজরীনের মতো ট্র্যাজেডি হয়েছে। অনেকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হয়েছেন।
রেহমান সোবহান, চেয়ারম্যান, সিপিডি

একই অধিবেশনে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, ‘উন্নয়নে সাফল্য আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অপশাসন (ম্যালগভর্ন্যান্স) আছে।’ তাঁর মতে, বিভিন্ন খাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশের উন্নয়নে বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) ভূমিকার প্রশংসা করেন রেহমান সোবহান। এসব উন্নয়ন সংস্থাকে তিনি ‘সামাজিক উদ্যোক্তা’ হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, এসব এনজিও গ্রামীণ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। গ্রামীণ ব্যাংক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থায় পরিণত হয়েছে। আর ব্র্যাক বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও। এগুলো বাংলাদেশের এনজিও খাতের সাফল্যের বার্তা দেয়।

রেহমান সোবহানের মতে, গত ৫০ বছরে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি পাল্টে গেছে। এখন গ্রামীণ এলাকায় অকৃষি খাতের দাপট বেড়েছে। আবার তৈরি পোশাক খাতের উত্থান হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। তিনি বলেন, একসময় এ দেশের শ্রমিকেরা কলকাতা, মুম্বাই ও করাচি যেতেন। এখন বলিভিয়ার জঙ্গল, সৌদি আরবের মরুভূমিতেও বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কাজ করেন।

তিন দিনের সম্মেলন শুরু

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক লিখিত বক্তব্য পাঠের মাধ্যমে তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধন হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে এই বক্তব্য পড়েন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি ও বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ বদলে গেছে। গত এক দশক ‘গেম চেঞ্জের’ দশক ছিল। গ্রামগঞ্জে মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, জনগণের নেতা মানুষের প্রত্যাশা বুঝতে পারেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন ধরনের নেতা।

বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে পাকিস্তানকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক—প্রায় সব ক্ষেত্রেই পেছনে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করেন বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। গত কয়েক দশকে ভারত ও পাকিস্তানে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে অংশগ্রহণ বেড়েছে। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, নগরে বসবাস করা মানুষের হারের দিক দিয়ে ওই দুটি দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। এর মানে, বাংলাদেশে নগরায়ণ দ্রুত গতিতে হচ্ছে।