ঋণখেলাপি হওয়ার নেশা, উন্নয়নের সূচক, সিঙ্গাপুর এবং গান ও ছবি

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আমার সরাসরি শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে তিনি আমাদের মাইক্রো অর্থনীতি পড়াতেন। আমরা বেশ ভয় পেতাম, তার চেয়েও বেশি ছিল শ্রদ্ধা। করোনাকালে সেই ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ স্যারকে সবাই পেলাম ভিন্ন এক পরিচয়ে। তিনি ছবি আঁকেন, যাঁরা তাঁকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুসরণ করেন, তাঁরা বিষয়টি জানেন। গায়ক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের পরিচয় অনেকের জন্যই নতুন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি একজন অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও শিক্ষক।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
ছবি: প্রথম আলো

করোনাকালের ঘরবন্দী জীবন। এই ঘরবন্দী জীবন সবার জন্যই নতুন অভিজ্ঞতা। কেউ কেউ একাকী জীবন কাটান, নতুন করে বিষণ্নতায় ভুগছেন কেউ কেউ, আবার অনেকেই ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন ভিন্নভাবে। লেখালেখি, গান, আড্ডা, ছবি আঁকা, স্মৃতি রোমন্থন-কতভাবেই না করোনাকাল কাটিয়ে দিচ্ছেন অনেকে।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আমার সরাসরি শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে তিনি আমাদের মাইক্রো অর্থনীতি পড়াতেন। আমরা বেশ ভয় পেতাম, তার চেয়েও বেশি ছিল শ্রদ্ধা। করোনাকালে সেই ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ স্যারকে সবাই পেলাম ভিন্ন এক পরিচয়ে। তিনি ছবি আঁকেন, যাঁরা তাঁকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুসরণ করেন, তাঁরা বিষয়টি জানেন। গায়ক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের পরিচয় অনেকের জন্যই নতুন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি একজন অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও শিক্ষক। এই সত্তারও বড় পরিচয় পাওয়া যায় ফেসবুকে তাঁর বিভিন্ন লেখায়। মাঝেমধ্যেই ছোট ছোট কিছু কথা লেখেন তিনি, যা নতুন ভাবনার খোরাক জোগায়।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নিজের আঁকা
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

১.

ডাক্তার এক নারী রোগীকে জানালেন, তিনি আর ছয় মাস বাঁচবেন। তাঁর পরামর্শ হলো একজন অর্থনীতিবিদকে বিয়ে করে নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপে গিয়ে থাকুন।

নারী: তাতে কি আমি বেশি দিন বাঁচতে পারব?

ডাক্তার: না, সময় কাটতে চাইবে না, ছয় মাসকে অনেক দীর্ঘ সময় মনে হবে।

ফেসবুকে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এই কৌতুকটি দিয়েছেন গত ৯ আগস্ট। সম্ভবত অর্থনীতিবিদদের সবচেয়ে প্রিয় কৌতুক গল্প এটাই। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই এটি তাঁদের লেখায় ব্যবহার করেন। এমনকি অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ দম্পতি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো তাঁদের নতুন বই, ‘গুড ইকোনমিকস ফর হার্ড টাইম’-এ এই গল্পটি ব্যবহার করেছেন।

অর্থনীতিবিদদের সঙ্গ এতটা খারাপ বলা হলেও ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের গাওয়া গান, আঁকা ছবি কিংবা চিন্তাভাবনা জাগানিয়া নানা লেখা অবশ্য তা বলছে না। তাহলে উদাহরণ দেওয়া যাক।

২.

বাজেট এলেই ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে ফোন দেন না এমন সাংবাদিক নেই বললেই চলে। তবে একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে নিজের অধিকারটা বজায় রাখতে খুব কষ্ট হয় না। নিজের ছাত্রের অনুরোধ তিনিও সহজে না করতে পারেন না।

বাজেট নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল গত ১২ জুন। সেই লেখাটি ফেসবুকের পাতায় শেয়ার দিয়ে তিনি লিখলেন, ‘করোনা বা বাজেট এ দুটোর কোনোটা নিয়েই বেশি চিন্তা করা ভালো না, শরীরের রোগপ্রতিরোধ শক্তি কমে।’

ঠিক পরের দিনই বাজেট নিয়ে তাঁর আরেকটি স্ট্যাটাস। তিনি লিখলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার ভূতের ভয়, যদিও অবশ্যই ভূতে বিশ্বাস করি না। অনেকে ভূতের ভয়ে আলো জ্বালিয়ে রাখে। আমি ঠিক উল্টোটা করি। বাসার সব বাতি তো বন্ধ করি, তার ওপর জানালার সব পর্দাও পুরো টেনে দিই, যাতে ঘরে কোনো আলোই আসতে না পারে। উদ্দেশ্য, ভূতরা এলেও যাতে দেখা দিতে না পারে। গতকাল রাতে সমস্যাটা বেশি হচ্ছিল। একে তো করোনার চিন্তা, তার ওপর সাংবাদিকদের অনুরোধে সদ্য ঘোষিত জাতীয় বাজেট নিয়ে কিছু একটু বলতে হয়েছিল; এ দুটোই সমান অপ্রিয় বিষয়, তাই ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছিল। ভাবলাম অন্ধকারে গান গাইলে যদি ভয়টা কমে। তা ছাড়া এ–ও মনে হলো ভূত যদি আসেও, গান শুনে যদি শান্ত থাকে। কোথাও যেন পড়েছিলাম বিশেষত শাকচুন্নি–পেতনিরা খুব হিংস্র হলেও গান গেয়ে নাকি তাদের বশে রাখা যায়। জুতসই গান কী হতে পারে? শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথই ভরসা: ‘‘তোমায় গান শোনাব…বুকে চমক দিয়ে যাও গো চলে…’’। তবু গলার স্বর একটু কাঁপা কাঁপা আর নিচু তো হবেই! ছবিটা অন্ধকার হলেও একটা কি ছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে না ’

অন্ধকারের সেই ছায়া দেখতে বা গানটি শুনতে হলে ঢুঁ মারতে হবে তাঁর ফেসবুক পাতায়।

স্ত্রীর সঙ্গে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

৩.

আরেকটি গানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেই হয়। গত ৯ জুলাই তিনি তাঁর গাওয়া একটি গান তুলে দিয়েছেন ফেসবুকে।

এ নিয়ে লিখেছেন, ‘লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে গবেষণার জন্য আমার প্রয়াত স্ত্রী সিমীন মাহমুদ আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত ছিলেন। ঘরোয়াভাবে এসব গবেষণার বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার যখন কখনো মতানৈক্য হতো আমার পক্ষে শেষ পর্যন্ত আলোচনাকে কোনো হালকা বিষয়ের দিকে মোড় ঘোরানো ছাড়া উপায় থাকত না। যেমন আমি একবার যুক্তি দেখিয়েছিলাম ক্ষেত্রবিশেষে কর্মসংস্থানের সুযোগের মতো সংগীত জগতেও কোনো কোনো বিশেষ গানের বেলায় লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন (gender sterotyping) প্রায় অবশ্যম্ভাবী। ষাটের দশকের জনপ্রিয় ছবি হারানো সুর-এর ততোধিক জনপ্রিয় গান ছিল গীতা দত্তের গাওয়া ‘‘তুমি যে আমার...’’, যে গানটি সে সময়ের প্রেমিক-প্রেমিকাদের জাতীয় সংগীত ছিল বললেও অত্ত্যুক্তি হবে না! অথচ এটিকে একটি মেয়েলি গান মনে করার কারণেই বোধ হয় কোনো পুরুষ সংগীতশিল্পী এটি গেয়েছেন বলে আমার চোখে পড়েনি; পুরুষ কণ্ঠে এটি মানায়ও না। আজ আমি নিজেই গানটি গেয়ে আমার থিওরির সত্যতা প্রমাণ করলাম। তার মানে অবশ্য এই নয় যে পুরুষ সংগীতশিল্পীরা এটি ভালো গাইবেন না!’

৪.

এবার অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। ঋণখেলাপি দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশেষ করে ঋণখেলাপিদের শাস্তি দেওয়ার আলোচনা এলেই একটা বিভাজন সরকারের তরফ থেকে করা হয়। আর সেটি হলো ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। কিন্তু কে যে ইচ্ছাকৃত আর কে নয়-তার কোনো সুরাহা হয়নি। যদিও অর্থমন্ত্রী বাজেটেই ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

এই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের নতুন এক দিক নিয়ে ফেসবুকে তিনি লিখলেন গত ৮ জুলাই। লেখার শিরোনাম ছিল—

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি একটা নেশা কেন?

মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের উত্তেজনা নিয়ে ইদানীংকালের গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে মানুষের অর্থনৈতিক আচরণের বিষয়ে কিছু নতুন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। এর ওপর ভিত্তি করে নিওরো-ইকোনমিকস বলে অর্থনীতির একটা নতুন ধারার গবেষণা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

দেখা গেছে মানুষের ভাবাবেগ, যা মস্তিষ্কের সামনের অংশের স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে, তা অনেক সময়েই পেছনের অংশের যুক্তিনির্ভর অংশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এর ফলে অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে মানুষের অর্থনৈতিক আচরণকে যুক্তিভিত্তিক বলে যে অনুমান করা হয়, বাস্তবে আবেগতাড়িত হয়ে মানুষ অনেক সময়েই তেমন আচরণ করে না।

দেখা গেছে মানুষের ভাবাবেগ, যা মস্তিষ্কের সামনের অংশের স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে, তা অনেক সময়েই পেছনের অংশের যুক্তিনির্ভর অংশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এর ফলে অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে মানুষের অর্থনৈতিক আচরণকে যুক্তিভিত্তিক বলে যে অনুমান করা হয়, বাস্তবে আবেগতাড়িত হয়ে মানুষ অনেক সময়েই তেমন আচরণ করে না। যেমন অতিরিক্ত আর্থিক লোভ কি করে অযৌক্তিক ঝুঁকি নিতে মানুষকে প্রলোভিত করে, তা দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির আর্থিক খাত এবং শেয়ারবাজারের বড় বড় ধসের ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা করা যায়।

তবে যে কারণে এ প্রসঙ্গটির অবতারণা, তা হলো নিওরো-সাইকোলজির গবেষণার একটা চমকপ্রদ নতুন ফলাফল। অপ্রত্যাশিত নতুন নতুন অর্থপ্রাপ্তি স্নায়ুতন্ত্রের যে বিশেষ অংশকে উত্তেজিত করে, মাদক আসক্তিও সেই অংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ধারণা করা হচ্ছে এ ধরনের অর্থপ্রাপ্তির লোভ এমনকি কোকেন বা এ ধরনের মাদক সেবনের নেশার মতো মারাত্মক হয়ে যেতে পারে। নেশাগ্রস্ত মানুষকে আইনকানুন দিয়ে বা উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে সংশোধন করা যায় না, প্রয়োজন তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। তা ছাড়া নেশাগ্রস্ত মানুষ অন্যদেরও প্ররোচিত করতে পারে। (সূত্র: Your Money and Your Brain: How the New Science of Neuroeconomics Can Help Make You Rich,” author Jason Zweig)

আমাদের ব্যাংকিং খাতের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা কেন বারবার একই কাজ করেন বা এ খাতের অন্যান্য লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের কেন নিবৃত্ত করা কঠিন তার অন্তত একটা আংশিক উত্তর উপরিউক্ত গবেষণা থেকে মিলতে পারে। তার অর্থ, ইতিমধ্যে এভাবে আসক্ত হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ছাড়া শুধু আর্থিক খাতের সংস্কার দিয়ে সমস্যার পুরো সমাধান মিলবে না।

তবে বৈধ পথে মুনাফা অর্জনের নেশা সফল উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় বড় বড় শিল্পপতিরা অগাধ ধনসম্পদের মালিক হয়েও যে আরও মুনাফা অর্জনের নেশায় সর্বক্ষণ তাড়িত হন, বিগত শতাব্দীর বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ সুম্পিটার একে একধরনের জৈবিক তাড়না বা animal spirit বলে অভিহিত করেছিলেন। আধুনিক নিউরো সায়েন্সের গবেষণা থেকে এখন এর আরও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা পাওয়া গেল।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নিজের আঁকা
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

৫.

জিডিপি কতটা অর্থনৈতিক সূচক, আর কতটা রাজনৈতিক—এ আলোচনাও আজকাল হচ্ছে। অর্থনীতিবিদেরা বহু আগেই থেকেই বলে আসছেন, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি উন্নয়নের একমাত্র মাপকাঠি নয়। উন্নয়নের ধারণাটি আরও বিস্তৃত। তবে রাজনীতিবিদদের সবচেয়ে প্রিয় সূচক এই জিডিপি, যদি তা বাড়তে থাকে।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এই উন্নয়ন ধারণার নতুন কিছু দিক তুলে আনলেন ৩ জুলাই। লেখাটি এ রকম—

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যতিক্রমী কিছু সূচক

বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাত্রা (সেটা যে ধরনের শাসনব্যবস্থার অধীনেই হোক) সাধারণত মাথাপিছু জাতীয় আয় বা জিডিপি দিয়ে মাপা হয়। তবে জাতীয় আয়ের পরিমাপ ও তুলনা করা নিয়ে অনেক সমস্যা আছে। অন্য কিছু সহজ সূচক ব্যবহার করে উন্নয়নের মাত্রা সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায় কি না, এ নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। আমার নিজের চলমান গবেষণায় সহজে চোখে পড়ে এমন কিছু ব্যতিক্রমী আর্থসামাজিক সূচক নিয়ে ভাবছি; সূচকগুলো বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের চিত্র নয় বরং সহজে দৃশ্যমান কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়ার বিষয়ে চিন্তা করছি। এ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নে নগরায়ণ যেহেতু অবশ্যম্ভাবী, সে জন্য শহরকেন্দ্রিক সূচকের দিকেই বেশি নজর দেওয়া হয়েছে:

১. রাজধানী বা বড় শহরগুলোর নদীপাড়ের চলার পথের নান্দনিক সৌন্দর্য।

২. শহরগুলোর রাস্তায় বাস বা গাড়ি চলাচলের পাশাপাশি পথচারীদের সুযোগ-সুবিধাকে কতখানি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

৩. রাস্তায় ট্রাফিক আইন মানা ও হর্ন বাজানোর মাত্রা।

৪. গণপরিবহন ব্যবস্থার মান ও শৃঙ্খলা (যেমন বাস ও অন্য গণপরিবহনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামার সুযোগ আছে কি নেই)।

৫. শহরগুলোর গণশৌচাগারের মান ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দৃশ্যমান চিত্র।

৬. নাগরিকদের প্রকাশ্য স্থানে স্বাস্থ্যগত শিষ্টাচার (যেমন থুতু ফেলা) মেনে চলার মাত্রা।

৭. খাদ্যে ভেজালের মাত্রা এবং শহরে ট্যাপের পানির মান ও গ্রামাঞ্চলে সুপেয় পানির লভ্যতা।

৮. গ্রামাঞ্চলের বসতবাড়ির বাহ্যিক রূপ ও শৌচাগার ব্যবস্থা।

৯. সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে যাত্রী পরিবহনের তুলনায় মৃত্যুর হার।

১০. শিক্ষিত নাগরিকদের বিদেশে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষার মাত্রা।

উন্নয়নের নীতিনির্ধারণের দিকনির্দেশনা দেওয়া এসব সূচকগুলোর মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং এগুলোকে উন্নয়নের মাত্রা নির্ধারণের কিছু দৃশ্যমান লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সুশাসন, ব্যবসায় পরিবেশ, মানব উন্নয়ন, মানবাধিকার ইত্যাদি উন্নয়নের নানা দিক নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিবছর বহু ধরনের সূচক প্রকাশ করে; এ ছাড়া মাথাপিছু জিডিপি বা জাতীয় আয়ের হিসাব তো আছেই। এসব সূচকগুলোর তথ্য-উপাত্ত, পরিমাপ পদ্ধতি ও তুলনামূলক উপযোগিতা নিয়ে অনেক আলোচনা-বিতর্কও আছে।

তবে একটা অনুন্নত দেশ থেকে কেউ উন্নত দেশে গিয়ে পড়লে তাকে সেটা বোঝার জন্য বইপত্র ঘেঁটে নিশ্চয়ই দেখতে হয় না যে ওই দেশটা মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী কোন শ্রেণিভুক্ত বা জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকেই বা দেশটি কত নম্বর পেয়েছে। যে দৃশ্যমান লক্ষণগুলো থেকে তাৎক্ষণিকভাবেই দেশটির উন্নয়নের মাত্রা সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যায় এই লেখাতে সেগুলোকেই সূচক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এর সঙ্গে অবশ্যই কিছু জনসচেতনতা ও নীতিনির্ধারণের বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত তো আছেই।

যেহেতু আমরা সরকারিভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছি, সে জন্য শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে হিসাব–নিকাশ না করে উন্নয়নের এসব ভিন্নধর্মী সূচকের কথাও ভাবতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নিজের আঁকা
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

‘করোনাভাইরাস নিয়ে আমাদের আগ্রহ আর তেমন নেই, কিন্তু আমাদের নিয়ে তার আগ্রহ কমেনি।’ এই স্ট্যাটাসটি ছিল গত ৪ আগস্টের।

আর আগেই অবশ্য তিনি মহামারির সময়কার অর্থনীতি নিয়ে নিজের ভাবনার কথা লিখেছিলেন তিনি। গত ১২ জুলাই তিনি লিখলেন

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও আয় বৈষম্য

চীনকে ব্যতিক্রম ধরলে এবং ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মাত্রার তারতম্য বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে, যেসব দেশে আয় বৈষম্য বেশি সেখানে সংক্রমণ বেশি দ্রুত বাড়ছে, লকডাউন কম কার্যকর হচ্ছে, সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধিসংক্রান্ত সরকারের নির্দেশনাকে কম বিশ্বাসযোগ্য মনে করছে এবং নিম্নবিত্ত মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগও কম। এটা উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ের দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত সবার বেলাতেই প্রযোজ্য। এটাও আশঙ্কা করা হচ্ছে যে এসব দেশে করানো–পরবর্তী সময়ে আয় বৈষম্য নানা কারণে আরও বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আয় বৈষম্য কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়ার গুরুত্ব আরও বেড়ে গেল।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নিজের আঁকা
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

৭.

ওই দিনই তিনি মজা করে দিলেন আরেকটি স্ট্যাটাস। ১২ জুলাই তিনি লিখলেন,—

‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও আয় বৈষম্য’ নিয়ে একটা লেখা পোস্ট করেছিলাম। তার ওপর অনেকে ভালো মন্তব্য এমনকি গবেষণা থেকে পাওয়া নতুন ফলাফলও সংযুক্ত করেছেন। এর মধ্যে একটি মন্তব্যে আমার প্রতিক্রিয়ায় দেখলাম অনেকের আগ্রহ তৈরি করেছে। সৈয়দা রত্না মন্তব্য করেছেন, ‘সেই ক্ষেত্রে আপনি কি সাজেশন দেবেন সরকারকে?’

আমার উত্তর: আমার এক শিক্ষাগুরুর একটা উপদেশ আমি মেনে চলি: সরকারকে কখনো গায়ে পড়ে উপদেশ দেবে না, তাহলে মনে করবে তুমি কোনো পদ পদবি চাচ্ছ!

৮.

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দির মাহমুদ একটা বিরতি ‍দিয়ে অর্থনীতি নিয়ে নতুন একটি লেখা দিলেন গতকাল শনিবার। একজন বিশেষজ্ঞের বক্তব্যের মধ্যে নিজের মন্তব্যও ঢুকিয়ে দিয়েছেন দিন। হয়তো নতুন ভাবনা খোরাক জোগাতেই। তিনি একটি ভিডিও ক্লিপ সংযুক্ত করে লিখলেন, ১৯৬৫ সনে স্বাধীনতা লাভের সময় সিঙ্গাপুর ছিল একটি অত্যন্ত দরিদ্র তৃতীয় বিশ্বের দেশ, আর এখন দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর অন্যতম।

এই ভিডিওটিতে সে দেশের উন্নয়ন গবেষক কিশোর মাহবুবানি নিজের জীবনব্যাপী অভিজ্ঞতা থেকে এই উন্নয়নের পেছনে প্রধান তিনটি নিয়ামকের উল্লেখ করেছেন, যেগুলো হলো

১. সব পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ (স্বজনপ্রীতি বা অন্য কোন বিবেচনার বিপরীতে),

২. দেশ শাসনের সর্বস্তরে সততা ও কর্তব্যপরায়ণতা (দুর্নীতির বিপরীতে) এবং

৩. বাস্তবতার বিবেচনায় নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

আশা করছি এসব বক্তব্য নতুন ভাবনা জোগাবে, করোনাকালের সময়টাও ভালো কাটবে।