‘এ দেশে কর ফাঁকি দিয়ে পার পাওয়া যায়’

সম্প্রতি দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী বিদ্যমান কর ব্যবস্থা নিয়ে আক্ষেপ করে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে চান বলে জানান। এরপর থেকেই দেশের করব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। করব্যবস্থা, হয়রানি, কর ফাঁকি—এসব নিয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য আমিনুর রহমান প্রথম আলোর কাছে তাঁদের অভিমত দিয়েছেন।

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বাংলাদেশে কর আহরণ একদম কম। এ ছাড়া করহারও তুলনামূলক বেশি। আবার কর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ আছে। কর ফাঁকিও যে হয় না, তা–ও নয়। এসব নিয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য আমিনুর রহমান প্রথম আলোর কাছে অভিমত দিয়েছেন।

আবুল কাশেম খান বলেছেন, দেশের করব্যবস্থা ব্যবসাবান্ধব নয়। হয়রানির ভয়ে অনেকে কর দিতে চান না। কর ফাঁকি দিয়েও একশ্রেণির ব্যবসায়ী পার পেয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে আমিনুর রহমান বলেছেন, ধনীরাই বেশি কর ফাঁকি দেন। এ দেশে কর ফাঁকি দিয়ে পার পাওয়া যায়—এমন বার্তাও সমাজে আছে। তবে দুজনেই বলেছেন, করহার যৌক্তিক করাসহ করব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। এবার দেখা যাক, কে কী বললেন।

আবুল কাশেম খান, সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার

‘কোনো ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি করপোরেট কর আরোপ’ 

আবুল কাশেম খান, সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার

বর্তমান বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের করপোরেট করহার প্রতিযোগিতামূলক নয়। আশপাশের দেশের চেয়ে অনেক বেশি। আবার করব্যবস্থাও ব্যবসাবান্ধব নয়। এ দেশের করব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে উৎসে কর কেটে রাখা হয়। ফলে কার্যকরভাবে করহার অনেক বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি করহার আরোপ হয়ে যায়। অথচ মোটাদাগে করপোরেট করহার সাড়ে ৩২ শতাংশ।

একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, আয়কর আইনের ৮২সি ধারার আওতায় যে অগ্রিম কর কাটা হয়, তা চূড়ান্ত কর হিসেবে ধরা হয়। এতে যেসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কোম্পানির পণ্যের পরিবেশক হিসেবে কাজ করে, তাদের কাছ থেকে লেনদেনের ওপর চূড়ান্ত দায় হিসেবে যে হারে উৎসে কর কাটা হয়, বাস্তবে তা তাদের ওপর সাড়ে ৩২ শতাংশের অনেক বেশি। কমবেশি ৫০ শতাংশের মতো কর দিতে হয় পরিবেশকদের। এমন ব্যবস্থাকে কোনোভাবেই করবান্ধব ব্যবসা বলা যায় না।

আবার যাঁরা নৈতিকতা নিয়ে ব্যবসা করেন, তাঁরাও বিদ্যমান করব্যবস্থা থেকে ঠকছেন। তাঁরা এক লাখ টাকা আয় করলে তার ওপরেই আয়কর দেন। আবার অনেক ব্যবসায়ী নিজেদের প্রকৃত আয় লুকিয়ে কর কম দেন। এর ফলে প্রতিযোগিতায় নৈতিক ব্যবসায়ীরা পিছিয়ে পড়েন। আর কর ফাঁকি দিয়েও একশ্রেণির ব্যবসায়ী পার পেয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত কম, কারণ এ দেশে জনসংখ্যার তুলনায় খুব কম লোক প্রত্যক্ষ কর দেন। আবার যাঁরা নিয়মিত কর দেন, তাঁদের ওপরেই কর দেওয়ার চাপ বেশি। বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো করের আওতার বাইরে।

করব্যবস্থায়ও গলদ আছে। যেমন কালোটাকা সাদা করার সুযোগ। একজন করদাতা নিয়মিতভাবে উচ্চ হারে কর দিলেন। কিন্তু সরকার ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিল। ফলে কর ফাঁকি দিয়ে যাঁরা টাকা লুকিয়ে রাখলেন, তাঁরা বেশি সুবিধা পেলেন। এটি সৎ করদাতাদের জন্য অন্যায় নীতি। এ কারণেও অনেক করদাতা কর দিতে চান না।

বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ কর দিতে চান। কিন্তু হয়রানির ভয়ে কর দেন না। এটাও বাস্তবতা যে কর দিলে একবার নিরীক্ষায় পড়লে নানা ধরনের হয়রানি হতে হয়। তবে মানুষকে বোঝাতে হবে, কর একধরনের বিনিয়োগ, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা হবে। তবে এসব বোঝাতে কিছুটা ভিন্ন কৌশল নেওয়া উচিত। করদাতারা কী চান, কোথায় কীভাবে বিনিয়োগ চান—এ নিয়ে সমীক্ষা হওয়া উচিত। এতে রাষ্ট্রের সঙ্গে করদাতাদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। তারা ফেসবুকসহ সামাজিকসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অনেক বেশি সক্রিয়। তাদের ইতিবাচকভাবে করের আওতায় আনতে হবে। মানুষ যখন দেখতে পাবে, করের টাকায় তাদের উন্নতি হচ্ছে—তাহলে তাঁরা কর দিতে উৎসাহিত হবেন। জনগণের মধ্যে একটা ধারণা আছে, সরকার তাদের টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এই ধারণার পরিবর্তন করতে হবে। কর একধরনের বিনিয়োগ, এই ধারণা দিতে হবে।

আমিনুর রহমান, সাবেক সদস্য, এনবিআর

‘ধনীরাই বেশি কর ফাঁকি দেন’

আমিনুর রহমান, সাবেক সদস্য, এনবিআর

বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে করের পরিমাণ খুব কম। কর-জিডিপি অনুপাতের তলানি থাকা একটি দেশ হলো বাংলাদেশ। এর কারণ, এ দেশে করজাল বড় নয়। বাংলাদেশে করব্যবস্থা ব্যবসাবান্ধব নয়। যাঁরা করব্যবস্থায় বা করের জালে নেই, তাঁরা কম আয়ের মানুষ। ছোট ছোট করদাতা হতে পারেন, এমন জনগোষ্ঠীকে করজালে আনা যাচ্ছে না। কিন্তু যাঁরা বড় করদাতা, তাঁরা যখন কর ফাঁকি দেন, এর পরিমাণও অনেক বেশি। দেখা গেছে, ৫০০ ছোট করদাতা মিলে যত টাকা কর ফাঁকি দেন, এর চেয়ে বেশি কর ফাঁকি দেন একজন বড় করদাতা।

সমাজে যাঁরা ধনী, তাঁদের আমরা সবাই চিনি। ধনীরাই বেশি কর ফাঁকি দেন। প্রতিবছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে সেরা করদাতার পুরস্কার দেওয়া হয়, সেই তালিকায় অখ্যাত আমদানিকারক ও ঠিকাদারের নামই বেশি। পরিচিত ও ডাকসাইটের ব্যবসায়ীদের নাম ওই তালিকায় খুব একটা দেখা যায় না। তাঁরা নানা কৌশলে কর ফাঁকি দেন। এসব কারণে এ দেশে প্রত্যক্ষ কর আদায় খুব বেশি বাড়েনি। এ ছাড়া এ দেশে কর ফাঁকি দিয়ে পার পাওয়া যায়—এমন বার্তাও সমাজে আছে। তবে করব্যবস্থা ব্যবসাবান্ধব করতে গিয়ে এতটা সহজ করা ঠিক হবে না, যেন সবাই কর ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যান। তাই ব্যবসাবান্ধব করব্যবস্থা প্রণয়নের পাশাপাশি কর ফাঁকি বন্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থাও থাকতে হবে।

কর আহরণের ক্ষেত্রে সহজ পথে আদায়কেই বেছে নেয় এনবিআর। প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে খুব বেশি শুল্ক-কর আদায় করতে পারে না এনবিআর। যেমন ভ্যাটের প্রায় সিংহভাগই আসে উৎসে ভ্যাট থেকে। উৎসে ও অগ্রিম কর থেকে আয়করের ৮৫ শতাংশের মতো কর আসে। উৎসে করের বেশির ভাগই দেন ঠিকাদার, আমদানিকারক ও ব্যাংক সেবা গ্রহণকারীরা।

কর দেওয়ার সময় এখন কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি দেখা হয়। এতে হয়রানির সুযোগ থাকে। তাই রিটার্ন দাখিল, শুল্ক-কর পরিশোধসহ সব কাজ যদি স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেশনে নেওয়া যায়, তাহলে করদাতাদের মধ্যে আস্থা আসবে। এতে তাঁরা কর দিতে উৎসাহিত হবেন।