‘কর ফাঁকি ধরে নিয়েই বোধ হয় ফরমটি ছাপানো হয়’

দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গতকাল শুক্রবার সকালেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ছোট স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন—
‘আন্তর্জাতিক একটি হিসাবে অতি ধনী বা কোটি কোটি টাকা আয় করা মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশেই সবচেয়ে দ্রুত বেড়েছে। অথচ, ইনকাম ট্যাক্স ফরমে আয়ের ঘরে লক্ষ টাকার অংক লেখার জায়গাও নেই। কর ফাঁকি ধরে নিয়েই বোধ হয় ফরমটি ছাপানো হয়!’

আয়কর রিটার্ন ফরমের এই ছবিটি পোষ্ট করেছেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

কথাগুলোর সঙ্গে তিনি আয়কর রিটার্ন ফরমের একটি ছবি দিয়েছেন। সেখানে আয়ের বিবরণী অংশে গৃহসম্পত্তি থেকে আয়ের ঘরে কিছু সংখ্যাও লেখা আছে। সেখানে আসলেই বেশি সংখ্যা লেখার সুযোগ নেই। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্ভবত ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়েলথ এক্সের দেওয়া হিসাবের কথা উল্লেখ করেছেন। ২০২০ সালের মার্চে ওয়েলথ এক্স এক প্রতিবেদনে বলেছে, অতি ধনী বৃদ্ধির তালিকায় সবার ওপরে আছে বাংলাদেশ। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের (৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী) সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। বাংলাদেশের পরই ভিয়েতনামের অবস্থান, সেখানে বেড়েছে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ হারে।

২০১০-১১ অর্থবছরে ১৪ লাখ করদাতা কর দিয়েছিলেন, আর এখন দেন ২২ লাখ। অর্থাৎ ১০ বছরে নতুন করদাতা বেড়েছে মাত্র ৮ লাখ। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে দ্রুত বেড়ে ওঠা অতি ধনীরা কোথায় গেলেন?

বর্তমানে দেশে ৪৬ লাখ কর শনাক্তকারী নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাঁদের মধ্যে ২০-২২ লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন দেন। আবার যাঁরা রিটার্ন দেন, তাঁদের মধ্যে ১০ শতাংশ শূন্য রিটার্ন জমা দেন। এর অর্থ, তাঁরা কোনো কর দেন না। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে তাঁদের কোনো ভূমিকা থাকে না। করদাতাদের মধ্যে অবশ্য ৭-৮ লাখই সরকারি কর্মকর্তা। প্রতি মাসে বেতন-ভাতা প্রদানের সময় ‘পে রোল ট্যাক্স’ হিসেবে কেটে রাখা হয়। মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ কর দেন।

গত এক দশকে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এ সময় দেশের মোট দেশজ উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে, মাথাপিছু আয়ও বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অথচ ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৪ লাখ করদাতা কর দিয়েছিলেন, আর এখন দেন ২২ লাখ। অর্থাৎ ১০ বছরে নতুন করদাতা বেড়েছে মাত্র ৮ লাখ। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে দ্রুত বেড়ে ওঠা অতি ধনীরা কোথায় গেলেন?

তাঁরা গেছেন কানাডা, মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশে। যেখানে অর্থ পাঠানো ও রাখা সবচেয়ে সহজ। এই ধনী শ্রেণির মধ্যে সবাই ব্যবসায়ী তা নন, সরকারি কর্মকর্তার পরিমাণও কম নয়। অবৈধ ব্যবসার অর্থ, ঘুষ-দুর্নীতির অর্থ-সব কিছুরই গন্তব্য এনবিআরের কাছে নয়, বরং অন্য কোনো দেশে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন যেমন গত সপ্তাহেই গোপনে কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশিদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে বলেছেন, ‘আমার ধারণা ছিল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’

আমার ধারণা ছিল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন যেমন গত সপ্তাহেই গোপনে কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশিদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে বলেছেন, ‘আমার ধারণা ছিল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’

মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে এবং এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন চারজন। এ ছাড়া কিছু আছেন আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী। আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করছি। তবে পাচারে শুধু কানাডা নয়, মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা।’

একে তো আয়কর দেয় খুবই কমসংখ্যক মানুষ। অনেকে আবার হয়রানির ভয়েও কর অফিসে যেতে চান না। বেশি আয় নেই, কিন্তু হয়রানি চান না, তাঁদের বড় অংশের জন্য কর দেওয়ার ভালো জায়গা ছিল আয়কর মেলা। এবার সেটিও নেই। সুতরাং পথ হচ্ছে একজন আয়কর আইনজীবীর সহায়তা নেওয়া অথবা নিজে নিজে ফরম পূরণ করে রিটার্ন দেওয়া। কিন্তু ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ঘরে বসে সেই ফরম পূরণ করতে গিয়েও পড়েছেন বিপত্তিতে। হাসি–ঠাট্টার আড়ালে সহজ ও সত্য কথাটাই হয়তো বলে দিয়েছেন।

স্ট্যাটাসটি ধরেই প্রশ্ন করেছিলাম ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কাছে। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলেন, ‘আমি তো একজন সাধারণ উচ্চ মধ্যবিত্ত পেশাজীবী। ফরমে যে জায়গা আছে তাতে আমার আয়ের পরিমাণ লেখারই জায়গা হয় না, ব্যবসায়ীদের জায়গা কি করে হবে।’

প্রশ্ন হচ্ছে আসলেই কি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর ফাঁকি ধরতে চায়? নাকি উৎসে বেশির ভাগ আয়কর আদায় হয়ে যায় বলে মনোযোগ এখানেই সীমাবদ্ধ। ছোট ছোট আয় পেয়েই তারা খুশি। বরং অতি ধনীদের কাছ থেকে কর বেশি আদায় হোক, যাঁরা কর না দিয়ে পাচার করছেন তাঁদের ধরা হোক। আয়কর রিটার্ন ফরমে কোটি কোটি টাকা ধরার জায়গা থাকবে সেটাই সবার প্রত্যাশা।