করোনা সংকটে দেশে বেকারত্বের তথ্য-উপাত্তে ঘাটতি

করোনা সংকট দেশে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এ সময়ে কত লোক কাজ হারিয়েছেন কিংবা কোন শ্রেণির মানুষ বেশি চাকরি হারিয়েছেন, এসব নিয়ে পর্যাপ্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছেও নেই হালনাগাদ তথ্য। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না থাকায় সুবিধাভোগী চিহ্নিত করে সঠিক উদ্যোগও নেওয়া যাচ্ছে না। তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির কারণে সঠিকভাবে নীতি প্রণয়নও করা যায় না।

কর্মসংস্থান নিয়ে গতকাল শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানের সভাপতি পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম তথ্য-উপাত্তের সংকটের কথা স্বীকার করেন। বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী তথ্য-উপাত্তের অভাব আছে। এ জন্য যেকোনো পরিকল্পনা তৈরি করার সময় ভুগতে হয়।’ শক্তিশালী তথ্য-উপাত্ত ভান্ডার তৈরি করতে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তা করতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

ওয়েবিনারে অর্থনীতিবিদ ও গবেষক বক্তারা বিবিএসকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার তাগিদ দেন।

 অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়েমা হক বিদিশা। করোনা পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশ কিছু প্রস্তাব দেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হলো করোনা সংকট মোকাবিলায় সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ ব্যাংকের পরিবর্তে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা। অন্য সুপারিশগুলো হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণের শর্ত শিথিল করা ও সুদের হার কমানো; বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিক, নারী উদ্যোক্তা ও তরুণদের জন্য আলাদা ঋণের ব্যবস্থা করা। তাঁর মতে, কর্মসংস্থান ও আয়ের সংকট কত দিন চলবে, তা নির্ভর করছে করোনার সময়সীমা ও সরকার গৃহীত উদ্যোগগুলোর ওপর।

সায়েমা হক বলেন, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কম হলে এবং করোনা সংক্রমণ উচ্চ হারে থাকলে চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হবে।

 মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন বক্তারা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিউিটটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনুসর বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নির্ণয়ের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নেই।

 আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় উদ্বেগ হলো করোনার পরে বিনিয়োগ পরিবেশ স্বাভাবিক না হলে বেসরকারি বিনিয়োগ আসবে না। তাই সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা উচিত। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায় কাঙ্ক্ষিত হারে হচ্ছে না। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বেশির ভাগ লোক তাঁদের কাজ ফিরে পাবেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

 সানেমের চেয়ারম্যান বজলুল হক খন্দকার শ্রমবাজারের ওপর সঠিক তথ্য-উপাত্ত রাখার বিষয়ে জোর দেন। এ জন্য তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, প্রণোদনার অর্থ ঠিকমতো দেওয়া যাচ্ছে না কেন? বলেন, ‘আবার সরকারিভাবে ৪ শতাংশ বেকার দেখানো হয়। কিন্তু প্রকৃত চিত্র এটি নয়। বিবিএসের দেখানো ৪ শতাংশ বেকারত্বের চিত্র আমাদের কোনো উপকারে আসছে না।’

করোনায় বিদ্যমান শ্রমবাজারের সংকট নিয়ে তিনটি সুপারিশ করেছেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। প্রথমটি হলো কর্মসংস্থান কমিশন গঠন। ওই কমিশন বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবে। অপর দুটি সুপারিশ হলো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঢেলে সাজানো ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করা।

 সেলিম রায়হান আরও বলেন, করোনার কারণে যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আনা যাচ্ছে না। তাঁর মতে, স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক সংকট ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব—এই তিনটিই করোনাকালের বড় সংকট।

তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির উদাহরণ দিয়ে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, কত লোক গরিব হয়ে গেছেন, এর কোনো সঠিক তথ্য–উপাত্ত নেই। তথ্য–উপাত্ত তৈরিতে বিবিএসকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি জানান, এপ্রিল মাসে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার কারণে দারিদ্র্যহার বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে। এই দারিদ্র্য হার কত দিন থাকে, সেটাই দেখার বিষয়। ইমরান মতিনের মতে, আগামী তিন মাস সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতি খুলতে শুরু করছে, শ্রমবাজার কী ধরনের আচরণ করে, সেটাই দেখার বিষয়।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পওতিয়ানেন বলেন, করোনা সংকটে শ্রমবাজার উন্নয়নে সরকারি–বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা উচিত। সরকারের কেনাকাটায় শ্রমঘন বিষয়টি প্রাধান্য দিলে অনেক কর্মসংস্থান হবে। এ ছাড়া গ্রাম এলাকায় অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সহায়তা দিলে বেশি কর্মসংস্থান হবে।

জিইডি সদস্য শামসুল আলম বলেন, আগামী দিনে মহামারি সংক্রমণ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে অর্থনীতি কবে ঘুরে দাঁড়াবে। এর সঙ্গে কর্মসংস্থানের বিষয়টিও জড়িত। তিনি বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সুদের সাড়ে ৫ শতাংশ সরকার দেবে। বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ উদ্যোক্তা নিজে বহন করবেন। এমন পরিস্থিতিতে সুদের হার আরও কমানোর যৌক্তিকতা আছে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।