করোনার কারণে বিদেশ যাওয়ার খরচ বেড়েছে ২৩ শতাংশ

সেলিম রায়হান

করোনার শুরুতে সারা পৃথিবী যখন বিধিনিষেধে চলে যায়, তখন বিশ্বব্যাংকসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাই বলেছিল, ২০২০ সালে বৈশ্বিক রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়প্রবাহ কমে যাবে। তখন আমাদের মনেও শঙ্কা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোটা দেখা গেল। এটা নিঃসন্দেহে অনেক বড় স্বস্তির জায়গা।

এই যে প্রবাসী আয় বাড়ল, এ প্রবণতার গভীরে যাওয়া দরকার মনে করি। আমরা আগে থেকেই জানতাম, দেশে বৈধ পথে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় আসে, অবৈধ পথেও প্রায় সমপরিমাণ প্রবাসী আয় আসে। কোভিডের মধ্যে এ অবৈধ পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৈধ পথে আসাটা বেড়ে গেছে, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আমরা সানেমের পক্ষ থেকেও যেসব জরিপ করেছি, সেখানেও এ বাস্তবতা উঠে এসেছে, অর্থাৎ খানাপর্যায়ে বাড়তি প্রবাসী আয়ের প্রভাব পড়েনি। অন্যদিকে সরকার বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনার জন্য যে ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, তার সুযোগও অনেকে নিয়েছেন।

একদিকে প্রবাসী আয় করমুক্ত, অন্যদিকে বৈধ পথে তা পাঠালে ২ শতাংশ অতিরিক্ত টাকা পাওয়া যাচ্ছে, সে কারণেও অনেকে বৈধ পথে টাকা পাঠাতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তবে সামগ্রিকভাবে প্রবাসী আয় বেড়েছে, এমন সিদ্ধান্তে আসা যাবে না।

এ ছাড়া আরেকটি প্রবণতা হলো, দেশে পরিবার সংকটে পড়লে অনেক প্রবাসী বেশি বেশি টাকা পাঠান। আবার তাঁরা যেসব দেশে থাকেন, সেসব দেশেও সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সে কারণে তাঁরা বেশি বেশি টাকা পাঠিয়েছেন। অনেকে আবার এ সুযোগে বিদেশে গচ্ছিত কালোটাকা সাদা করতে বৈধ পথে টাকা পাঠিয়েছেন। এ রকম নানা ব্যাপার এখানে কাজ করেছে বলেই মনে করি। তবে মোদ্দাকথা হলো, এ সংকটের সময় প্রবাসী আয় আসা কমেনি। অর্থনীতিতে তার প্রভাব আছে।

এখন কথা হচ্ছে প্রবাসী আয় কী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা সবাই জানি, প্রবাসী আয় মূলত ভোগে ব্যয় হয়ে থাকে। উৎপাদনশীল কাজে তার খুব একটা ব্যবহার হয় না। আরও সমস্যা হচ্ছে, সংকটের সময় প্রবাসী আয় আরও বেশি হারে ভোগে ব্যয় হয়। অধিকাংশ পরিবারের আয় যেখানে কমেছে, সেখানে প্রবাসী আয় ভোগেই বেশি ব্যয় হবে, এমনটাই স্বাভাবিক। আমার প্রস্তাব হচ্ছে এই যে সরকার বৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠানোর জন্য প্রণোদনা দিচ্ছে, তাকে উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহারের শর্ত জুড়ে দেওয়া। শুধু শর্ত জুড়ে দিলেই চলবে না, তার একটা বন্দোবস্ত থাকতে হবে।

এখন পর্যন্ত প্রবাসী আয়প্রবাহ কমেনি, কিন্তু মহামারি যেভাবে দীর্ঘায়িত হচ্ছে, একের পর এক ঢেউ আসছে, তাতে ভবিষ্যতে প্রবাসী প্রবাহে টান পড়বে না, এমন কথা হলফ করে বলা যাবে না। যেসব দেশে আমাদের দেশের শ্রমিকেরা যাচ্ছেন, সেই দেশগুলোও সংকটে আছে। ফলে তারা কত শ্রমিক নেবে, সেটা নির্ভর করবে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর ওপর। এ পরিস্থিতিতে সেই দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বৃদ্ধি করা উচিত। এ যোগাযোগ থাকলে শ্রমিক পাঠানো সহজ হয়। এর সঙ্গে আছে স্বাস্থ্যবিধির শর্ত।

অথচ আমরা দেখছি বিদেশগামী শ্রমিকেরা টিকা নিতে গিয়ে কী ধরনের হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এটা উদ্বেগজনক। কারণ, এমনিতেই শ্রমিক যাওয়া কমে গেছে, তার সঙ্গে যদি আমরা সময়মতো তাঁদের টিকা দিতে না পারি, তাহলে তা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। শ্রমিক যেতে না পারলে কিন্তু প্রবাসী আয়ের প্রবাহ এমন না–ও থাকতে পারে।

এ ছাড়া শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ফি। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যত টাকা দাবি করে, তাতে অনেকের পক্ষেই বিদেশে যাওয়া সম্ভব হয় না। আমাদের সানেমের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে জানা গেছে, শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার খরচ বেড়েছে ২৩ শতাংশ। আমাদের এ জরিপে দেখা গেছে, করোনার সময় ২০ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন এবং ৫ শতাংশ দেশে ফেরত এসেছেন। এ পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করার বিকল্প নেই। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সেই সক্ষমতা দেখা যাচ্ছে না।
মহামারির আগে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের গতি শ্লথ ছিল। করোনার প্রাদুর্ভাবে এ সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া নির্ভর করছে শ্রমবাজার কত দ্রুত পুনরুদ্ধার করা যায় তার ওপর।
এ পরিস্থিতিতে সরকারের মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা দরকার।

সেলিম রায়হান: নির্বাহী পরিচালক, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)