করোনায় খরচের তুলনায় আয় কমেছে বেশি

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) করোনাকালীন আয়, ব্যয়, বেকারত্বের প্রভাব তুলে ধরেছে। সংস্থাটি বলছে, করোনায় মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চ মাসে প্রতি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকায়। অর্থাৎ পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় কমেছে প্রায় চার হাজার টাকা।

গত ১৩ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিবিএস এই জরিপ করেছে। করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানার বাধ্যবাধকতা থাকায় বিবিএস প্রথমবারের মতো টেলিফোনে এই জরিপ করে। গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটক—এই চার মুঠোফোন কোম্পানির ২ হাজার ৪০ জন গ্রাহকের নম্বর সংগ্রহ করে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বিবিএসের জরিপকারীরা।

বিবিএস গতকাল মঙ্গলবার ‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ: জীবিকার উপর অভিঘাত ধারণা জরিপ’ প্রকাশ করেছে। সেখানে আয় কমে যাওয়ার এ চিত্র উঠে এসেছে। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার ছয় মাস পর সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো আয়, ব্যয়, দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে জরিপের ফলাফল পাওয়া গেল। গতকালের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘এই জরিপ বিদ্যমান জনবল দিয়ে দ্রুততম সময়ে বিবিএস করেছে। আমরা অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব দ্রুত কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। বিবিএসের জরিপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।’

করোনার সময়ে মানুষের আয় কমেছে, আবার ব্যয়ও কমেছে। তবে যেভাবে আয় কমেছে, সেভাবে খরচ কমেনি। ফলে নাগরিকদের ভোগান্তি বেড়েছে। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী গত মার্চ মাসে দেশের পরিবারপ্রতি মাসিক খরচ ছিল ১৫ হাজার ৪০৩ টাকা। গত আগস্ট মাসে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ১১৯ টাকায়। এর মানে, আয় কমে যাওয়ায় ভোগের চাহিদাও কমেছে।

জরিপে অংশ নেওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে প্রায় ৬৮ শতাংশ পরিবার করোনায় কোনো না কোনোভাবে আর্থিক সমস্যায় পড়েছে। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পরিবার করোনাকালে জীবন ধারণ করতে গিয়ে আর্থিকভাবে বিপাকে পড়েছেন।

গত ১৩ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিবিএস এই জরিপ করেছে। করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানার বাধ্যবাধকতা থাকায় বিবিএস প্রথমবারের মতো টেলিফোনে এই জরিপ করে। গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটক—এই চার মুঠোফোন কোম্পানির ২ হাজার ৪০ জন গ্রাহকের নম্বর সংগ্রহ করে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বিবিএসের জরিপকারীরা। তাঁদের মধ্যে ৯৮৯ জন বিবিএসের জরিপকারীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। গড়ে প্রত্যেকের সঙ্গে ৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ড কথা বলেন তাঁরা। এরপর তাঁদের উত্তরের ভিত্তিতে জরিপের ফলাফল তৈরি করা হয়।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুযায়ী, কোনো চাকরি বা কাজপ্রত্যাশী যদি সপ্তাহে এক ঘণ্টাও মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে তাঁদের বেকার হিসেবে ধরা হয়। বিবিএস এখানে সেই হিসাবই ধরেছে।

মানুষের আয় কমার ফলে চলমান করোনার সময়ে দেশের দারিদ্র্য বা বেকার পরিস্থিতি কেমন ছিল? বিবিএস বলছে, করোনা শুরুর তিন-চার মাসে ব্যাপকভাবে বেকারত্ব বেড়েছে। মার্চ মাসের তুলনায় জুলাই মাসে বেকারত্ব ১০ গুণ বেড়েছিল। বিবিএস বলছে, গত মার্চ মাসে বেকারত্বের হার ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ। জুলাইয়ে তা বেড়ে হয় ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অবশ্য এখন পরিস্থিতির বেশ উন্নতিও হয়েছে। সেপ্টেম্বরে এসে বেকারত্বের হার নেমে এসেছে ৪ শতাংশে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুযায়ী, কোনো চাকরি বা কাজপ্রত্যাশী যদি সপ্তাহে এক ঘণ্টাও মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে তাঁদের বেকার হিসেবে ধরা হয়। বিবিএস এখানে সেই হিসাবই ধরেছে।

করোনা শুরুর পর অনানুষ্ঠানিকভাবে, বিশেষ করে দিনমজুর, রিকশাচালকসহ দিন আনে দিন খায় মানুষেরা কাজ হারাতে শুরু করেন। বিবিএস বলছে, তাতে জুলাইয়ে বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ওই সময়ে এসে শ্রমশক্তিতে থাকা প্রতি চারজনে একজন বেকার হয়ে পড়েন। তবে বিবিএস বলছে, পরের দুই মাসে বেকারত্ব পরিস্থিতির উন্নতি হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এসে বেকারত্বের হার আবার আগের অবস্থার কাছাকাছি ফিরে যায়। যদিও এত দ্রুততম সময়ে বেকার পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, করোনার প্রথম তিন-চার মাসে যত বেকার হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এখনো কাজ পাননি। চাকরির বাজার এখনো আগের পর্যায়ে ফিরে আসেনি।

বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত সঠিক আছে বলেই মনে করি। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। করোনার কারণে মানুষের আয় কমেছে।’ তাঁর মতে, বেকারত্ব বাড়লে দারিদ্র্য বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম

করোনার কারণে আয় কমে যাওয়া, বেকার বেড়ে যাওয়া—এসব চিন্তা করে সরকার বিভিন্ন ধরনের সহায়তা কর্মসূচি চালু করে। বিবিএসের জরিপে অংশ নেওয়া পরিবারগুলো বলছে, তাদের মধ্যে ২১ দশমিক ৩৩ শতাংশ পরিবার সরকারি সহায়তা নিয়েছে। এর মানে, এক-পঞ্চমাংশ পরিবার বিভিন্ন ধরনের সরকারি সহায়তা পেয়েছে। যেসব পরিবারের মাসিক আয় ২০ হাজার টাকার কম, তাদেরই মূলত সরকারি সহায়তা দেওয়া হয়।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত সঠিক আছে বলেই মনে করি। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। করোনার কারণে মানুষের আয় কমেছে।’ তাঁর মতে, বেকারত্ব বাড়লে দারিদ্র্য বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।