ক্রেতাদের লাইনে আনতে না পারলে আমরা লাইনচ্যুত হব

মোস্তাফিজ উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড
ডেনিম এক্সপার্টের সৌজন্যে

তৈরি পোশাকের বড় বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের নরম-গরম সম্পর্ক। দেশে পোশাক খাত বড় হওয়ার পেছনে তাদেরও অবদান কম নয়। তবে করোনাভাইরাসের মহামারির শুরুর দিকে সেই ক্রেতাদের নতুন চেহারা আমাদের কাছে উন্মোচিত হয়েছে।

করোনাকালে অধিকাংশ ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানই পোশাক ক্রয়ের চুক্তি অমান্য বা পাশ কাটিয়ে দায়িত্বহীন আচরণ করেছে। একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে। কারখানায় পণ্য প্রস্তুত থাকলেও তা নিতে চায়নি অনেকে। উৎপাদন চলমান থাকা পণ্যের কাঁচামালের দাম পরিশোধ করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কেউ কেউ আবার মূল্য পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধি করার মতো অন্যায্য শর্ত জুড়ে দেয়। প্রস্তুতকৃত পণ্যের ওপর বিশাল অঙ্কের মূল্যছাড় দেওয়ার জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে চাপ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো পোশাক কেনার ক্ষেত্রে একদিকে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করে, আর অন্যদিকে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা ও শ্রমিকের কল্যাণের কথা বলে। বিষয়টি সত্যিই হাস্যকর।
মোস্তাফিজ উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড

বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, পণ্যের মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে সরবরাহকারী কারখানাকে ক্রেতার সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হয়। করোনাকালে কিছু ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান তাদের সরবরাহকারী কারখানার পাশে দাঁড়িয়েছে। আবার প্রচলিত ক্রয়চুক্তি ভঙ্গের ফলে যেহেতু কোনো শাস্তির বিধান নেই, তাই অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানই সেই সুযোগ নিয়েছে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে আর্থিক সংকটে পড়ে যায় কারখানাগুলো। যার প্রভাবে লাখ লাখ পোশাকশ্রমিক বিপদে পড়েন। সরকার বেতন দেওয়ার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ দিলেও অনেক কারাখানা সেই সুবিধাটা নিতে পারেনি।

ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো পোশাক কেনার ক্ষেত্রে একদিকে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করে, আর অন্যদিকে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা ও শ্রমিকের কল্যাণের কথা বলে। বিষয়টি সত্যিই হাস্যকর। যদিও ক্রেতাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ক্রয় আচরণের কারণে কারখানা ও শ্রমিকদের ওপর কী ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বেটার বায়িং উদ্যোগের কারণে অনেকের কাছে তা পরিষ্কার হয়েছে।

আশা করেছিলাম, রানা প্লাজা ধসের পর চুক্তির মাধ্যমে যেভাবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের চাপে পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স গঠিত হয়েছিল, তেমন কিছু হবে। অথবা সরকারের তরফ থেকে বিষয়টি তদারকির কার্যকর পদক্ষেপ আমরা দেখব। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা কোনো রকম পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না।

অবশ্য গত বছর ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ার ব্যাপক সমালোচনার পর ভেবেছিলাম, একটা ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। ক্রেতারা ন্যায্য ক্রয়চুক্তিতে ফিরবে। আশা করেছিলাম, রানা প্লাজা ধসের পর চুক্তির মাধ্যমে যেভাবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের চাপে পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স গঠিত হয়েছিল, তেমন কিছু হবে। অথবা সরকারের তরফ থেকে বিষয়টি তদারকির কার্যকর পদক্ষেপ আমরা দেখব।দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা কোনো রকম পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না।

পোশাকের দরপতন অব্যাহত রয়েছে। ক্রয়াদেশের তুলনায় কারখানার সংখ্যা বেশি হওয়ায় তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। সে কারণে পণ্যের মূল্য ক্রমেই নিম্নমুখী। তবে কিছু উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। শীর্ষস্থানীয় পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশের যৌথ উদ্যোগে ম্যানুফ্যাকচারার্স পেমেন্টস অ্যান্ড ডেলিভারি টার্মস ইনেশিয়েটিভ শীর্ষক একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছে, যা স্টার নেটওয়ার্কের আওতাধীন। জার্মান পার্টনারশিপ ফর সাসটেইনেবেল টেক্সটাইল ঘোষণা করেছে যে ২০২১ সালে তাদের বার্ষিক কর্মসূচি হবে পারচেজিং প্র্যাকটিস বা ক্রয়চর্চা। সংস্থাটির মতে, দায়িত্বপূর্ণ ক্রয়চর্চা কারখানার উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ ও শ্রমিকদের সময়মতো মজুরি প্রদানে সহায়তা করে। একইভাবে এটি কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতেও সক্ষম।

দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য ক্রেতাদের ক্রয়চুক্তিটি আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সেখানে চুক্তি ভঙ্গ করলে শাস্তির বিধান থাকবে, যেটি ক্রেতা ও সরবরাহকারী মেনে চলতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে।

অবশ্যই উদ্যোগগুলো প্রশংসনীয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এসব উদ্যোগে কি পোশাকশিল্পের প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে পারবে? উত্তরটা কঠিন। তবে এক দশক ধরে ক্রয় আচরণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। গত এক বছর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক কথাবার্তা হলেও পরিবর্তন হয়নি। আইনস্টাইন তো বলেছেন, একই কাজ বারবার করে ভিন্ন ফল প্রত্যাশা করা পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। তাই নতুন কিছু করতে হবে। শক্ত উদ্যোগ নিতে হবে। যেহেতু বৈশ্বিক সমস্যা, তাই সমাধানও বৈশ্বিক হওয়া উচিত।

দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য ক্রেতাদের ক্রয়চুক্তিটি আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সেখানে চুক্তি ভঙ্গ করলে শাস্তির বিধান থাকবে, যেটি ক্রেতা ও সরবরাহকারী মেনে চলতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে। পুরো বিষয়টি হবে ইন্ডাস্ট্রি চার্টার বা শিল্পের সনদ, যা একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা তদারক করবে।

ব্র্যান্ড, উৎপাদনকারী, শ্রমিক ইউনিয়নসহ শিল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই সনদে স্বাক্ষর করবেন। এ সনদ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অ্যাকর্ডের মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। তবে শুরুতে অ্যাকর্ড কেবল বাংলাদেশের জন্য গঠিত হয়েছিল। শিল্প সনদটি হবে বৈশ্বিকভাবে অনুসরণীয় ও অবশ্যপালনীয়। যাতে করে কোনো নির্দিষ্ট প্রতিযোগী দেশ বা কোম্পানি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত না হয়। এ ক্ষেত্রে স্টার নেটওয়ার্ক উদ্যোগ নিতে পারে। তবে তা যেন স্বেচ্ছায় না হয়। কেননা স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত কোনো কাজ সাধারণত কার্যকর বা সফল হয় না।

করোনাকালে ক্রেতাদের আচরণে অনেক দেশের পোশাকশিল্প মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে আমাদের মতো অন্য দেশগুলো লোকসানে পড়েছে কি না, সেটি পরিষ্কার নয়। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে জানাতে পেরেছি। তাই পুরো ক্রয়চুক্তিতে ন্যায্যতা ফেরানোর কাজটি সম্পন্ন করতে আমাদেরই সোচ্চার হতে হবে। কারণ, ক্রেতাদের লাইনে আনতে না পারলে আমরাই লাইনচ্যুত হয়ে যাব।
লেখক : মোস্তাফিজ উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড