জমি–ফ্ল্যাটে কালোটাকা তৈরির পথ বন্ধে দুই পরামর্শ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

জমি-ফ্ল্যাট কেনাবেচার মাধ্যমে কালোটাকা তৈরির পথ বন্ধে দুটি পথ বাতলে দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তাঁর প্রথম পরামর্শ, জরিপের ভিত্তিতে এলাকা ভেদে জমি ও ফ্ল্যাটের কাঠা বা বর্গফুটপ্রতি প্রকৃত বাজারদাম বের করে তার ভিত্তিতে কিছুদিন অন্তর অন্তর রেজিস্ট্রেশনের বাস্তবসম্মত ন্যূনতম দাম ঠিক করা। দ্বিতীয় পরামর্শ হচ্ছে, যদি আবাসন খাতের কোম্পানিগুলোর দাবি মেনে জমি বা ফ্ল্যাটের বিক্রয়মূল্যের অনুপাতে রেজিস্ট্রেশনসংক্রান্ত ফি বা মাশুলের হার কমানো। ওয়হিদউদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, এমন কোনো আইন থাকা উচিত নয়, যার মাধ্যমে অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কালোটাকা তৈরি হয়। পাশাপাশি সৎ করদাতাদের কালোটাকার মালিক হতে অনেকটা বাধ্য করা হয়।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আজ রোববার তাঁর ফেসবুকে এ বিষয়ে একটি বক্তব্য তুলে ধরেন। সেখানেই তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। গত বুধবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে জমি-ফ্ল্যাট কেনাবেচায় কীভাবে কালোটাকা তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

অর্থমন্ত্রী ওই দিন বলেন, ঢাকা শহরে যাঁদের জমি বা ফ্ল্যাট আছে, তাঁরা সবাই এক অর্থে ‘কালোটাকার মালিক’। যে ফ্ল্যাট দুই কোটি টাকায় নিবন্ধিত হচ্ছে, সেই ফ্ল্যাটের প্রকৃত দাম ১০ কোটি টাকা। ফলে সরকার বাড়তি নিবন্ধন মাশুল পাচ্ছে না। এখানেই কালোটাকা সৃষ্টি হচ্ছে। এ বিষয়গুলো সবাইকে বুঝতে হবে। ঢাকা শহরে যাঁর জায়গা আছে কিংবা যে ব্যক্তি জায়গা কিনেছেন, শুধু তিনিই বলতে পারবেন, কত টাকায় নিবন্ধন করা হয়েছে এবং জমির প্রকৃত বাজারদর কত? এ পরিস্থিতির জন্য সরকার ও বিদ্যমান ‘সিস্টেম’ বা ব্যবস্থাকে দায়ী করেন তিনি।

অর্থমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের পরই আজ এ নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

স্ট্যাটাসে যা লিখেছেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী, মাননীয় অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যে যাঁদের ঢাকা শহরে জমি বা ফ্ল্যাট আছে, তাঁরা সবাই কালোটাকার মালিক। কালোটাকা বলতে তিনি আয়কর রিটার্নে ‘অপ্রদর্শিত’ আয়কে বুঝিয়েছেন। বিশেষ করে গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার উদাহরণ দিয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য নিয়ে কোনো আলোচনা চোখে পড়েনি। আবাসন খাতের কোম্পানিগুলোর সংগঠন রিহ্যাব বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় ফ্ল্যাট বিক্রয়ের নিবন্ধন ফি কমানোর দাবি করলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

দেশে ব্যাপক হারে কর ফাঁকির প্রবণতা জানা কথা। কিন্তু অর্থমন্ত্রী জমি বা ফ্ল্যাট কেনা-বেচার বিদ্যমান আইনি প্রক্রিয়ার একটি অসংগতি উল্লেখ করে ওই মন্তব্য করেছেন। সরকার বিভিন্ন অঞ্চলের জমি বা ফ্ল্যাট হস্তান্তরের নিবন্ধনের জন্য একটা দাম বেঁধে দিয়েছে (জমি বা ফ্ল্যাটের আয়তন অনুযায়ী)। অর্থমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, গুলশান এলাকার জন্য এই বেঁধে দেওয়া মূল্যের থেকে প্রকৃত মূল্য পাঁচ-ছয় গুণ বেশি। কাজেই যিনি ওই দাম দেখিয়ে বিক্রি করছেন, তাঁর বিক্রয় থেকে পাওয়া আয়ের অধিকাংশের জন্য বৈধ উৎস আয়কর কর্তৃপক্ষকে দেখাতে পারবেন না এবং অপ্রদর্শিত থেকে যাবে। অর্থমন্ত্রীর মতে, এভাবে আইনের অসংগতি থেকে এমনিতেই কালোটাকা তৈরি হচ্ছে।

তবে অর্থমন্ত্রী সম্ভবত অসাবধানতাবশত একটি ভুল তথ্য দিয়ে সবাইকে ঢালাওভাবে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। নিবন্ধনের জন্য যে দাম বেঁধে দেওয়া আছে সেটি সর্বোচ্চ নয়, বরং ন্যূনতম। যাতে অন্তত এই মূল্যের ওপর উৎসে আয়করসহ নিবন্ধনসংক্রান্ত যাবতীয় ফি আদায় হয়। কিন্তু এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি প্রকৃত মূল্য দেখিয়ে নিবন্ধন করতে তো কোনো বাধা নেই। ওই সব অভিজাত এলাকায় প্রকৃত মূল্যে বিক্রির নিবন্ধন করে বিক্রয় থেকে পাওয়া পুরো অর্থ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করার নজির আমার কাছে আছে। আর অনেকেই যাঁরা এসব এলাকায় সরকারের কাছ থেকে জমি বরাদ্দ পেয়ে আবাসন কোম্পানির মাধ্যমে অ্যাপার্টমেন্ট বা ভবন বানিয়ে ভাড়া দিচ্ছেন, তাঁরাও অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি না করে থাকলে এভাবে কালোটাকার মালিক হওয়ার কথা নয়।

তবে অর্থমন্ত্রী সমস্যাটি ঠিকই চিহ্নিত করেছেন। নীতিমান কোনো করদাতা প্রকৃত মূল্য দেখিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রির নিবন্ধন করতে চাইলেও ওই মূল্য দেখিয়ে কিনতে আগ্রহী ক্রেতা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়। নিবন্ধন করার বেশি ফি তো আছেই, তার ওপর ওই দাম পরিশোধ করার মতো বৈধ বা ‘প্রদর্শিত’ আয় আছে—এমন ক্রেতা অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। সেটাও অর্থমন্ত্রীর সঠিক অনুমান।

আরও পড়ুন