দুই মহামারির সঙ্গে লড়ছে বিশ্ব

অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী রবার্ট শিলার। ছবি: রয়টার্স
অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী রবার্ট শিলার। ছবি: রয়টার্স

নতুন করোনাভাইরাস আর্থিক খাত ও অর্থনীতিতে এক গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। একই কথা বিপরীতভাবেও সত্য। এই চক্র ভাঙা সহজ নয়; তবে অসম্ভবও নয়।

বর্তমানে আমরা যে উদ্বেগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তার উৎস একটি নয় দুটি মহামারি। প্রথমটি হচ্ছে কোভিড-১৯ মহামারি, যা আমাদের নিজেদের বা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে থাকা আমাদের প্রিয়জনদের হঠাৎ ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া এমনকি মৃত্যু নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, প্রথমটির কারণে অর্থনীতিতে পড়া প্রভাব নিয়ে তৈরি হওয়া উদ্বেগের মহামারি।

এই দুই মহামারিই পরস্পর সংযুক্ত হলেও একই রকম নয়। দ্বিতীয় মহামারিটির ক্ষেত্রে শঙ্কার গল্পগুলো ভাইরাসের মতোই ছড়িয়ে পড়ছে, যা নিয়ে আমরা খুব কমই ভাবছি। ভারী পাথরের মতো নেমে যাচ্ছে শেয়ারবাজার। কোভিড-১৯ সম্পর্কিত গল্পগুলোর প্রভাবেই সম্ভবত আমরা কোনো উদ্যোগ নেওয়ার বদলে জীবনের সঞ্চয়গুলো ফুরিয়ে ফেলছি। কোভিড-১৯ ছাড়াও আমাদের উদ্বেগের আরেকটি উৎস হচ্ছে অনিশ্চয়তা। আমরা জানি না ঠিক কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

এটি খুবই বড় দুঃসংবাদ যে দুটি মহামারি একযোগে কাজ করছে। এর একটি আরেকটিকে প্রকট করতে পারে। বন্ধ ব্যবসা, বেকারত্ব বৃদ্ধি ও আয় হারানোর ধারা আর্থিক উদ্বেগ বৃদ্ধির জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে, যা আবার রোগটি মোকাবিলায় যথেষ্ট পূর্বসতর্কতা গ্রহণ ছাড়াই লোকেদের কাজ যোগ দিতে মরিয়া করে তুলতে পারে।

এর চেয়েও বাজে সংবাদ হচ্ছে, দুটিই (কোভিড-১৯ ও আর্থিক খাতের উদ্বেগ) সংক্রামক ব্যাধির মতো বৈশ্বিক মহামারি সৃষ্টি করছে। চাহিদার অবনমন যখন কোনো একটি দেশে আবদ্ধ থাকে, তখন তার আংশিক প্রভাব পড়ে বাইরে। যেহেতু ওই দেশের রপ্তানি চাহিদায় বড় ধস নামে না। কিন্তু এখন এই স্বাভাবিক নিরাপত্তা ভাল্‌ভটি কাজ করছে না। কারণ, মন্দা প্রতিটি দেশকেই চোখ রাঙাচ্ছে।

অনেকেই মনে করছেন, আর্থিক খাতের উদ্বেগটি কোভিড-১৯ সংকটের একটি সরাসরি সহ-উৎপাদন (বাইপ্রোডাক্ট) ছাড়া আর কিছু নয়। এটিকে এমনকি সংক্রামক ব্যাধির কারণে সৃষ্ট মহামারির একটি যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া হিসেবেও দেখা হচ্ছে। কিন্তু এই উদ্বেগ পুরোপুরি যৌক্তিক নয়। পণ্যমূল্য কমে যাওয়া বা আখ্যান বদলের মতো আর্থিক খাতে যে উদ্বেগের মহামারি চলছে, তার নিজস্ব একটি সত্তা আছে।

পুঁজিবাজারে যে আর্থিক উদ্বেগ প্রভাব ফেলছে, তা বুঝতে হলে আমাদের এমন একটি ধারণার শরণ নিতে হবে, যাকে ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী পল স্লোভিক ও তাঁর সহকর্মীরা বলছেন, ‘অ্যাফেক্ট হিউআরিস্টিক’ (মানুষের অনুসন্ধান স্পৃহায় পড়া প্রভাব)। যখন নানা বিয়োগান্ত ঘটনায় মানুষ হতাশ হয়ে পড়ছে, তখন তারা এমন অনেক ঘটনায় ভীত হয়ে পড়ছে, যেখানে আদতে ভয়ের কিছুই নেই।

উইলিয়াম গোয়েটজম্যান ও ড্যাসল কিমের সঙ্গে এক যৌথ গবেষণায় আমরা দেখেছি, কাছাকাছি কোথাও ভূমিকম্প হলে লোকেদের মধ্যে এই শঙ্কা তৈরি হয় যে শেয়ারবাজারে ১৯২৯ কিংবা ১৯৮৭ সালের মতো ধস নামবে। দেখা গেছে, ৩০ দিনের মধ্যে আশপাশের ৩০ মাইল এলাকার মধ্যে কোথাও ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটলে শেয়ারবাজারে ধসের আশঙ্কা করা লোকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এটিই হচ্ছে সেই ‘অ্যাফেক্ট হিউআরিস্টিক’। (অর্থাৎ মানুষ এ সময় শঙ্কার যুক্তি অনুসন্ধান না করেই শঙ্কিত হয়।)

ভূমিকম্পের বদলে মহামারি রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে শেয়ারবাজারে ধসের আশঙ্কাকে অনেক বেশি যৌক্তিক মনে হতে পারে। তবে এটি সাম্প্রতিক অতীতের মতো অত বড় হবে, এমন আশঙ্কার কারণ নেই। যদি বিশ্বাস করা যেত যে কয়েক মাসের মধ্যেই কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ ঠেকাতে ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলা যাবে কিংবা এক বা দু বছরের বেশি এটি স্থায়ী হবে না, তবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারীদের জন্য শেয়ারবাজারে বিদ্যমান ঝুঁকিকে খুব বড় মনে হতো না। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনে সংকট উত্তরণ পর্যন্ত তা ধরে রাখার পরিকল্পনা করতে পারতেন।

কিন্তু আর্থিক উদ্বেগের সংক্রমণ রোগের সংক্রমণের চেয়ে ভিন্নভাবে কাজ করে। এটি চালিত হয় চেইন রি-অ্যাকশনের মতো করে। মানুষের একাংশের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি যখন অন্যদের দৃষ্টিগোচর হয়, তখন পণ্যমূল্য অবনমন হয়। আর এটি অন্যদের মধ্যে আবেগময় প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। শেয়ারবাজারে নেতিবাচক বুদবুদটির সৃষ্টি হয় তখন, যখন মানুষ দেখে শেয়ারের দরপতন হচ্ছে। তারা তখন এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দরপতনের কারণগুলোর নতুন নতুন ব্যাখ্যা হাজির করে, যার একটি অন্যটির চেয়ে ভয়াবহ। আর এটিই নিয়ে আসে টানা দরপতনের বাস্তবতা।

শেয়ারের টানা দরপতন সেসব মানুষের মধ্যে ভয়াবহ হতাশার সৃষ্টি করে, যারা তাদের কাছে থাকা শেয়ার এখনো বিক্রি করেনি। একই সঙ্গে এটি এমন এক শঙ্কার সৃষ্টি করে, কোনো কোনো ব্যক্তি একেবারে কম দামে শেয়ার বিক্রি করে দেয়। এই হতাশা ও ভয় মহামারি-সংক্রান্ত বিভিন্ন ব্যাখ্যার প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তোলে। বাজার শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা মুখ্যত নির্ভর করে এই প্রবণতা ও এর বিবর্তনের ওপর।

উদাহরণস্বরূপ, ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সময়ে মার্কিন শেয়ারবাজারে তেমন কিছু অনুভূত হয়নি। যদিও মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোতে স্প্যানিশ ফ্লুর খবর প্রচারিত হয়েছিল। ওই মহামারিতে ৬ লাখ ৭৫ হাজার মার্কিন মারা পড়েছিল (সারা বিশ্বে মৃতের সংখ্যা ৫ কোটি ছাড়িয়েছিল)। কিন্তু এর মধ্যেও ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত মার্কিন শেয়ারবাজারে ছিল ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা।

ওই ভয়াবহ মহামারিতেও শেয়ারবাজারে পতন হয়নি কেন? এর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৮ সালের জুলাই-আগস্টে মারনেতে দ্বিতীয় যুদ্ধের পর যা শেষ হবে হবে করছিল। এই খবরে ইনফ্লুয়েঞ্জার গল্প আর হালে পানি পায়নি। যুদ্ধের গল্প ফ্লুয়ের গল্পের চেয়ে বেশি সংক্রামক ছিল।

আরেকটি কারণ হতে পারে মহামারি-সংক্রান্ত বিদ্যা তখনো শিশু বলা যায়। মহামারি তখন এখনকার মতো পূর্বাভাসযোগ্য ছিল না এবং মানুষেরা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে পুরোপুরি বিশ্বাস করত না। ফলে সামাজিক দূরত্ব মানার মতো পদক্ষেপগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ছিল কম। এ ছাড়া সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, অর্থনৈতিক সংকট মানে ব্যাংকিং খাতের সংকট। আর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতে সে সময় কোনো সংকট ছিল না, যেহেতু কয়েক বছর আগে ১৯১৩ সালেই গঠন করা হয়েছিল ফেডারেল রিজার্ভ, যা খাতটির ঝুঁকি অপসারণের দায়িত্বে নিয়োজিত হয়।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল, ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির সময় আর্থিক খাত সম্পর্কিত তথ্য এতটা প্রচারের আলোয় ছিল না। একই সঙ্গে এক শতক আগে খুব কম লোকের হাতেই ছিল শেয়ারের মালিকানা। একইভাবে অবসরোত্তর জীবনের জন্য সঞ্চয়ের দিকেও আজকের মতো মানুষের এত মনোযোগ ছিল না। এ ছাড়া মানুষের আয়ুষ্কাল এত বেশি ছিল না এবং পরিবারের ওপর নির্ভরশীলতা খুবই সাধারণ বিষয় ছিল।

এই সময়টি নিশ্চিতভাবেই একেবারে আলাদা। আমরা স্থানীয় মুদি দোকানগুলোতেও আতঙ্কিত মানুষের আনাগোনা দেখছি, যেমনটা দেখা যায়নি ১৯১৮ সালে। কারণ যুদ্ধের কারণেই সে সময় পণ্য সরবরাহের সংকট নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মহামন্দার তাজা অভিজ্ঞতা থাকায় সম্পদ-মূল্যের বড় অবনমনের বিষয়ে আমরা এই সময়ে অনেক বেশি সচেতন। বিয়োগান্ত বিশ্বযুদ্ধের বদলে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে নিজের রাজনৈতিক মেরুকরণ দ্বারাই বেশি আক্রান্ত। আর সংকট মোকাবিলায় ফেডারেল সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কিত বহু রাগী ব্যাখ্যা তো বাজারেই রয়েছে।