দেশে ছদ্মবেকার ১ কোটি ২৫ লাখ

দেশে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে পুরুষের তুলনায় নারীর কর্মসংস্থান বেশি হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে নারী বেকার কমেছে সাড়ে চার লাখ আর পুরুষ বেকার কমেছে দেড় লাখ। তবে এখনো ১২ লাখ পুরুষ আর ৯ লাখ নারী বেকার। এই ২১ লাখ বেকার সপ্তাহে এক ঘণ্টাও মজুরির বিনিময়ে কাজ পাননি।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রকাশিত ‘স্টাডি অন এমপ্লয়মেন্ট, প্রোডাকটিভিটি অ্যান্ড সেক্টরাল ইনভেস্টমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেশে বেকারত্বের নতুন এই চিত্র উঠে এসেছে। সাধারণত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) নির্দিষ্ট সময় পরপর বেকারত্ব, শ্রমশক্তি, কর্মজীবীর সংখ্যা—এসবের তথ্য-উপাত্ত সরকারিভাবে প্রকাশ করলেও জিইডি প্রথমবারের মতো এ ধরনের জরিপ করল।

জিইডির সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে সার্বিকভাবে বেকারের সংখ্যা কমে এখন ২১ লাখে নেমে এসেছে। ২০১৮ সাল শেষে বেকারের এই হিসাবটি করেছে জিইডি। তবে বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৭ সালে দেশে ২৭ লাখ বেকার ছিল। তার মানে, এক বছরের ব্যবধানে বেকারের সংখ্যা কমেছে ছয় লাখের মতো।

বিবিএসের মতে, দেশে ২০১৭ সালে বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। জিইডি এখন বলছে, বেকারত্বের হার কমে ৩ দশমিক ১ শতাংশে নেমেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুযায়ী, মজুরির বিনিময়ে সপ্তাহে এক ঘণ্টার কম কাজের সুযোগ পান, এমন মানুষকে বেকার হিসেবে ধরা হয়।

বেকারের সংখ্যা কীভাবে কমল, এমন প্রশ্নের জবাবে জিইডির সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতিতে বহুমুখী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এত দিন বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপে এসব আসেনি। তিনি উদাহরণ দেন, পাঠাও-উবারের মতো রাইড শেয়ারিংয়ে বিপুলসংখ্যক তরুণের কর্মসংস্থান হয়েছে। আবার শহর এলাকায় বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে নিরাপত্তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কর্মী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

তবে এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তাঁর মতে, বিনিয়োগ এমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়েনি যে যা কর্মসংস্থানের চিত্রটি পাল্টে দিতে পারে। তিনি প্রশ্ন করেন, উবার-পাঠাওয়ের চালক কিংবা নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা কি অতি মাত্রায় বেড়েছে, যা জাতীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানে প্রভাব ফেলতে পারে? তাঁর মতে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কাজ না করে বেঁচে থাকা মুশকিল। বেকারত্বের সংজ্ঞার কারণে অনেকেই বাদ পড়ে যান। যেমন, অনেকেই কাজ করছেন, কিন্তু কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নন। এই সংখ্যাও বিশাল ও আশঙ্কাজনক। বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী আছেন, যাঁরা কাজের মধ্যেও নেই, আবার পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণে নেই। এটি বেশ উদ্বেগের বিষয়, শ্রমশক্তির অপব্যবহার হচ্ছে। তাই এসব বিষয়ে সরকারকে বেশি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

অবশ্য জিইডির প্রতিবেদনে এসব হিসাবও উঠে এসেছে। জিইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, একশ্রেণির তরুণ-তরুণী আছেন (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী), যাঁরা কাজের মধ্যেও নেই, আবার পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণেও নেই। তাঁরা আসলে ছদ্মবেকার। এই সংখ্যাও নেহাতই কম নয়। জিইডির হিসাবে, দেশে এমন ছদ্মবেকারের সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ। জিইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ ধরনের উচ্চ হারের নিষ্ক্রিয় তরুণ গোষ্ঠীর কারণে জনসংখ্যা বোনাসের সুযোগ হুমকির মুখে পড়তে পারে।

এই বিপুলসংখ্যক বেকারের বাইরেও নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নয় কিংবা পছন্দের কাজ পাচ্ছেন না, এমন কর্মজীবীর সংখ্যাও কম নয়। তবে কাগজ-কলমে তাঁরা বেকার নন। জিইডির হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে এমন প্রায় ১ কোটি ৩৮ লাখ তরুণ-তরুণী আছেন। তাঁদের মধ্যে পুরুষ ১ কোটি ১৫ লাখের বেশি এবং নারীর সংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ। তাঁদের কেউ টিউশনির মতো অস্থায়ী কাজ করেন, কেউ চাকরি হারানোর শঙ্কায় আছেন। আবার কেউবা শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাননি। কারও কারও মজুরিতে পোষায় না। জিইডির ভাষায়, এই ধরনের কর্মসংস্থানকে বলা হয়েছে ‘আন্ডারএমপ্লয়মেন্ট’।

শ্রমশক্তি

জিইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ আছেন প্রায় ৬ কোটি ৪০ লাখ। তাঁরা কাজের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকেন। তবে এই হিসাবে, পড়াশোনা করেন কিংবা অসুস্থ কিংবা অন্য কোনো কারণে কাজের জন্য প্রস্তুত নন; তাঁরা এই শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হন না। কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে ৬ কোটি ১৯ লাখ লোক মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন। এর মধ্যে ৪ কোটি ৫৯ লাখ পুরুষ আর নারী ১ কোটি ৬০ লাখ।

২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসে মাঠপর্যায়ে এ জরিপটি করেছে জিইডি। ৬৪ জেলার সাড়ে ১০ হাজার খানায় গিয়ে জরিপটি করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ের তথ্যের ভিত্তিতে গত মে মাসে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।