পুরোনো তথ্যে জাতীয় খানা তথ্যভান্ডার

২০১৮ সালের তথ্য-উপাত্ত দিয়েই জাতীয় খানা তথ্যভান্ডার তৈরি হচ্ছে। করোনার সময় নতুন গরিবদের তথ্য মিলবে না।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

আবদুস সালাম ঢাকা শহরের একজন সেলুনকর্মী। করোনার আগে ব্যবসা ভালোই চলছিল। স্ত্রী–সন্তান, বৃদ্ধ মাসহ চারজনের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সালাম। দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে বসবাস সালামের পরিবারের।

কিন্তু মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। এপ্রিল, মে ও জুন—পুরো তিন মাস সালামকে বাসায় বসে থাকতে হয়েছে। সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালিয়েছেন। আবদুস সালাম প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, জুলাই মাস থেকে আবার সেলুন খুলেছেন। কিন্তু রোজগার আগের চেয়ে অর্ধেকে নেমেছে। বাড়ি বদলে দুই রুমের টিনশেড বাসায় উঠেছেন। আত্মীয়স্বজনের কাছে ধারদেনা করে জোড়াতালি দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন।

কিন্তু গল্পটা অন্য জায়গায়। ২০১৮ সালে জাতীয় খানা তথ্যভান্ডার শুমারির তথ্য সংগ্রহের সময় সালামের পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। তখন সালামের আয়রোজগার ভালো ছিল, তাই তিনি গরিবের পর্যায়ে ছিলেন না। কিন্তু এখন জাতীয় খানার যে তথ্যভান্ডার তৈরি হচ্ছে, তাতে সালাম আয়রোজগার, সামাজিক অবস্থান আগের মতোই দেখাবে। বিদ্যমান কর্মসূচির আওতায় সরকারি সহায়তার জন্য যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে না। কিন্তু এই তথ্যভান্ডারের কাজ যদি সময়মতো অর্থাৎ ২০১৭ সালে শেষ হতো, তাহলে হয়তো করোনা বিপদগ্রস্ত হিসেবে কিছু সহায়তা পেতে পারতেন আবদুস সালাম।

জাতীয় খানা তথ্যভান্ডারের কাজ শেষ করতে না পারায় দুই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। যেমন করোনায় প্রকৃত বিপদগ্রস্তদের সবার কাছে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি এবং তথ্যভান্ডারটি ২০১৮ সালের পরিবারগুলোর তথ্য দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। ফলে আগামী বছর প্রকল্পটি শেষ হলেও করোনার কারণে নতুন করে কারা গরিব, কারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে আছেন, তা জানা যাবে না। এমনকি তথ্য হালনাগাদ কীভাবে করা হবে, সেই কৌশলও ঠিক হয়নি। এমনকি সরকারের কোন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ এই তথ্যভান্ডারের ব্যবস্থাপনা ও হালনাগাদের দায়িত্বে থাকবে, তা–ও ঠিক করা হয়নি।

বিবিএসের গড়িমসির কারণে এই তথ্যভান্ডার সময়মতো হয়নি। সরকারের হাতে তথ্যভান্ডারটি থাকলে করোনার সময় খুব ভালোভাবে কাজে লাগানো যেত। যেমন সরকার ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ প্রণোদনার দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব হতো।
আহসান এইচ মনসুর, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক

২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ৩২৯ কোটি টাকায় জাতীয় খানা তথ্যভান্ডার তৈরির প্রকল্প নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য—দেশের সব খানার আয়, ব্যয়, সামাজিক অবস্থান—এসবের তথ্যভান্ডার তৈরি করা। যাতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুবিধাভোগীয় সহজেই চিহ্নিত করা যায়। সময় ও খরচ দ্বিগুণ বৃদ্ধির পর এখন আগামী বছরের জুন মাসে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বিবিএসের গড়িমসির কারণে এই তথ্যভান্ডার সময়মতো হয়নি। সরকারের হাতে তথ্যভান্ডারটি থাকলে করোনার সময় খুব ভালোভাবে কাজে লাগানো যেত। যেমন সরকার ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ প্রণোদনার দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব হতো।

প্রথম মেয়াদে কাজই শুরু হয়নি

প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৩ সালের জুলাই মাসে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু ওই সময়ে প্রকল্পের মূল কাজ অর্থাৎ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ শুরু করা যায়নি। প্রথম দুই বছর শুধু কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হবে, এর কৌশল ঠিক করতেই চলে যায়। এ ছাড়া তথ্য সংগ্রহকারীদের প্রশিক্ষণ দিতেও বেশ সময়ক্ষেপণ হয়। খানার তথ্যশুমারির তথ্য সংগ্রহ করা হয় কাগজে। কাগজের প্রশ্ন-উত্তরপত্র থেকে তথ্য-উপাত্ত ইলেকট্রনিক ফরম্যাটে অর্থাৎ কম্পিউটারে তোলা পর্যন্ত যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার জন্য এ সময়ে বাংলাদেশ, ভারত ও জার্মানির তিনটি প্রতিষ্ঠানকে যৌথ কাজ দেওয়া হয়।

২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। তিন দফায় প্রতিবার ২০ দিন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রথম দফায় বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহের ৯০ লাখ পরিবারের তথ্য-উপাত্ত নেওয়া হয়। তিন দফায় সব মিলিয়ে সাড়ে ৩ কোটি পরিবারের প্রতিটি পরিবারের প্রধানের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। নাম, ঠিকানা, বয়স, পরিবারের সদস্যসংখ্যা ও তাঁদের যাবতীয় তথ্য, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি কতজন, তাঁদের আয়কর কত, সম্পদের পরিমাণ, বাড়িঘর কী দিয়ে বানানো—সব মিলিয়ে ৩৫ ধরনের তথ্য নেওয়া হয়। এসব তথ্যের ভিত্তিতে একটি স্কোর তৈরি করা হবে, যাতে ওই ব্যক্তির আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান কী, তা বোঝা যায়। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে তথ্য সংগ্রহের পর দুই বছর ধরে তা ইলেকট্রনিক ফরম্যাট বা কম্পিউটারে সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক শ্রেণিবিভাজনের কাজও চলছে এখন।

খরচ ও মেয়াদ দ্বিগুণ বেড়েছে

২০১৩ সালে যখন প্রকল্পটি নেওয়া হয়, তখন খরচ ধরা হয় ৩২৯ কোটি টাকা। মেয়াদ ছিল সাড়ে চার বছর। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারায় প্রকল্পটির মেয়াদ ও খরচ বাড়ানো হয়। এখন সাড়ে চার বছরের প্রকল্প প্রায় আট বছরে শেষ হবে। খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২৭ কোটি টাকা।

কেন খরচ ও মেয়াদ বাড়ল, এমন প্রশ্নের প্রকল্পের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, যখন প্রকল্পটির প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছিল, তখন সাড়ে চার বছরে প্রকল্পটি শেষ করা যাবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে প্রশ্নপত্র তৈরি, কী ধরনের তথ্য জানতে চাওয়া হবে, এসব ঠিক করতেই সময় চলে যায়। এ ছাড়া যে প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রনিক ফরম্যাটে তথ্য-উপাত্ত রূপান্তর করবে, তাদের নিয়োগ দিতেও সময় লাগে। জানা গেছে, ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুই বছরের বেশি সময় লাগে।

সময়ে শেষ হলে যা হতো

জাতীয় খানাভিত্তিক তথ্যভান্ডার তৈরি করার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের প্রকৃত গরিবদের সরকারি সহায়তা দেওয়া। যেমন একটি উপজেলায় কতজন বিধবা নারী, কতজন হতদরিদ্র, কতজন পরিবারের সন্তান স্কুলে যাচ্ছে, এ ধরনের তথ্য জানা যেত। এ ছাড়া কারা আবার দারিদ্র্য হওয়ার ঝুঁকিতে আছে, তা–ও বোঝা যেত। তাহলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি পরিচালনাকারী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো সহজেই তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে প্রকৃত সুবিধাভোগী চিহ্নিত করে সুরক্ষা সহায়তা পৌঁছে দিতে পারত।

করোনার সময় তথ্যভান্ডারটির অভাব তীব্রভাবে টের পাওয়া গেছে।

এখন যা হতে পারে

গত বুধবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, জাতীয় খানাভিত্তিক তথ্যভান্ডার তৈরির জন্য তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণের কাজ চলছে। সব তথ্যই দুই বছর আগের। এর মানে, আগামী বছর যখন তথ্যভান্ডারের কাজ শেষ হবে, তখন সব তথ্যই থাকবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাঠপর্যায় থেকে নেওয়া তথ্যে। এতে কিছু বিপত্তি দেখা যেতে পারে। যেমন করোনার সময়ে যাঁরা গরিব হয়েছেন, তাঁদের আর গরিব দেখানো হবে না। আবার যাঁরা ঘরবাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন, কিন্তু জাতীয় তথ্যভান্ডারে থাকবে তাঁরা এখনো ওই ঘরবাড়ির মালিক।

এ বিষয়ে প্রকল্পের উপপরিচালক কাজী তোফায়েল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তথ্যভান্ডারে ২০১৮ সালের তথ্য–উপাত্ত সংরক্ষণ করা হচ্ছে। নতুন করে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করা না হলে হালনাগাদ তথ্য মিলবে না।’

তাহলে হালনাগাদ করার উপায় কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর মেয়াদ বৃদ্ধি কিংবা নতুন প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। সেটি সরকারের নীতিগত বিষয়।’

‘তথ্যভান্ডারে ২০১৮ সালের তথ্য–উপাত্ত সংরক্ষণ করা হচ্ছে। নতুন করে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করা না হলে হালনাগাদ তথ্য মিলবে না।’
কাজী তোফায়েল হোসেন, প্রকল্পের উপপরিচালক

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে জানা গেছে, ভবিষ্যতে জাতীয় তথ্যভান্ডারে তথ্য হালনাগাদ করার জন্য কোনো প্রকল্প পরিকল্পনা আপাতত নেই। ফলে ভরসা এই পুরোনো তথ্যভান্ডার।

এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুরের মত হলো, আগামী বছর বিবিএস তথ্যভান্ডারটি তৈরি করার পর এর ব্যবস্থাপনা ও তথ্য হালনাগাদ করার দায়িত্ব একটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে দেওয়া উচিত।