প্রবাসীদের না আসাও হবে আরেকটি বড় ধাক্কা

সিলেটের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। সংগঠনটির সভাপতি আবু তাহের মোহাম্মদ শোয়েব। তিনি স্থানীয় সিলেট হলি গেট ও লা ভিসতা হোটেলের চেয়ারম্যান এবং সিলটেন সিকিউরিটিজের এমডি। করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের নাজুক পরিস্থিতি ও ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে গত শুক্রবার রাতে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উজ্জ্বল মেহেদী

আবু তাহের মোহাম্মদ শোয়েব

প্রশ্ন :

করোনাভাইরাসজনিত লকডাউন কাটিয়ে সিলেটের ব্যবসা-বাণিজ্য এখন কেমন চলছে?

এখনো যেন করোনাকালই অতিবাহিত করছি। কারণ, টানা প্রায় দুই মাসের লকডাউন বা সাধারণ ছুটি শেষে সবকিছু খোলা হলেও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রাণ ফিরে পায়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য অলমোস্ট ডেড। নিত্যপণ্যের দোকানপাট ছাড়া অন্যান্য ব্যবসা একেবারেই নাজুক অবস্থায়। বিশেষ করে পর্যটন, আমদানি-রপ্তানি খাত কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন :

অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল-রেস্তোরাঁয় কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। এতে বেকারত্ব দেখা দিয়েছে। এই নিয়ে আরেক সংকট, আপনারা কীভাবে দেখছেন?

প্রতিষ্ঠানের আয় নেই, কাজও কমেছে। তাই কর্মীর সংখ্যা সীমিত করা হয়েছে। সিলেটে পর্যটননির্ভর হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোয় এ অবস্থা বেশি। আমাদের জানামতে, ৩০ থেকে ৪০ ভাগ কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। কাজ ও কর্মীর প্রয়োজন হলে আবার তাঁদের কর্মস্থলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। কাজ না থাকায় কর্মীরা কর্মসংস্থান হারিয়েছেন।

সরকারের আর্থিক প্রণোদনা ছাড়া ব্যবসায়িক স্থবিরতা কাটানো অসম্ভব। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা যেন প্রণোদনা পান, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। আমরা বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, কিন্তু তারা পর্যাপ্ত সহযোগিতা করছে না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।
আবু তাহের মোহাম্মদ শোয়েব, সভাপতি, সিলেট চেম্বার

প্রশ্ন :

এই অবস্থার মধ্যেও তো ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা কি হচ্ছে?

ঘুরে তো দাঁড়াতেই হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা যেন ঘুরে দাঁড়ানোর অবলম্বন খুঁজে পাচ্ছেন না। এই যেমন, সিলেটের প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মৌসুম বর্ষাকাল থেকে শুরু হয়ে শীতকাল পর্যন্ত চলে। আমরা হিসাব করে দেখেছি, লকডাউনের সময়ে শুধু পর্যটন খাতেই প্রতিদিন দুই থেকে তিন কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। লকডাউন প্রত্যাহার হলেও পর্যটনকেন্দ্রগুলোর অবস্থা স্বাভাবিক নয়। বিছনাকান্দি, রাতারগুল, জাফলং, সাদাপাথরসহ সিলেট অঞ্চলের প্রাকৃতিক পর্যটনগুলো এখনো ফাঁকা কিংবা বন্ধ। পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় রকমের স্থবিরতা বিরাজ করছে।

প্রশ্ন :

সরকারের কাছে সিলেট চেম্বার এক হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা চেয়েছিল। এ ব্যাপারে কী হলো?

কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুব সামান্য পর্যায়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীকে প্রণোদনা হিসেবে ব্যাংকঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তা সংখ্যায় কম হওয়ায় এটা কোনো পরিবর্তন আনবে না। আমরা খাতওয়ারি সরকারি আর্থিক প্রণোদনা চেয়েছিলাম। সেই চাওয়া এখনো পূরণ হয়নি, আমরাও আশা ছাড়িনি। সরকারের আর্থিক প্রণোদনা ছাড়া ব্যবসায়িক স্থবিরতা কাটানো অসম্ভব। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা যেন প্রণোদনা পান, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। আমরা বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, কিন্তু তারা পর্যাপ্ত সহযোগিতা করছে না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। ব্যবসায়ীরা যাতে প্রণোদনা পান, সে জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি করা প্রয়োজন। ব্যবসা চাঙা করতে না পারলে অনেক ব্যবসায়ী ঝরে পড়বেন, বেকারত্ব বাড়বে। সংগত কারণেই তখন সামাজিক অস্থিরতাও বাড়বে।

প্রশ্ন :

বেকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থানে বন্ধ পাথর কোয়ারি খোলার দাবি জানাচ্ছে পাথর ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন। সিলেটের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন হিসেবে চেম্বার কি এ দাবিতে একাত্ম?

পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি ও পাথরশ্রমিকদের প্রাণহানির শঙ্কায় করোনা পরিস্থিতির আগে থেকেই পাথর কোয়ারি বন্ধ রাখা হয়েছে। আমরা চাই, যে কারণে পাথর কোয়ারি বন্ধ রাখা হয়েছিল, সেগুলোর যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয়। যেমন, পাথর কোয়ারিগুলোতে অবৈধ যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি, শ্রমিকদের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব যেন না হয়। পরিবেশবান্ধব উপায়ে পাথর উত্তোলনে বিশেষ নজরদারি রেখে পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়া হোক। সিলেটে যেহেতু সেই অর্থে কোনো বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই, তাই শ্রমিকশ্রেণির কর্মহীনতা ঘোচাতে পাথর কোয়ারি সচল করতে হবে।

প্রশ্ন :

করোনার ধাক্কা কাটাতে আপনাদের কোনো দাবি আছে?

আমরা সিলেটের ব্যবসায়ীরা অনেক আগে থেকেই একটি শিল্পপার্ক স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছি। শোনা যাচ্ছে, ইউরোপ ও জাপানের অনেক কোম্পানি চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। এ সুযোগ তো আমরাও নিতে পারি। যদি সঠিক বিনিয়োগের পরিবেশ আমরা তৈরি করতে পারি, তাহলে অন্যান্য দেশ আমাদের এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিল্পপার্ক স্থাপনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি সিলেটকে শিল্পমুখী করতে পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে আগামী পাঁচ বছর ট্যাক্স হোলি ডে প্রদান ও কারিগরি শিক্ষায় ভর্তুকি বৃদ্ধি করতে হবে। চা–শিল্পেও বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।

প্রশ্ন :

আর কী করলে ব্যবসা-বাণিজ্য আবার ঘুরে দাঁড়াবে?

করোনা পরিস্থিতিই এখন সবচেয়ে বড় বাধা। এই পরিস্থিতি কবে শেষ হবে, তা অজানা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রপ্তানি বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আর কী কী করা যায়, এসব নিয়ে আমরা সাংগঠনিকভাবে চিন্তাভাবনা করছি। সিলেট চেম্বারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময় করা হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় করছি। করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরনও পাল্টেছে। অনলাইনের ক্ষেত্র বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমরা চাই হাইটেক পার্ক ঘিরে ভবিষ্যতের উপযোগী ব্যবসার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হোক। এ নিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সিলেট চেম্বার বসবে। সিলেটে প্রচুর অনাবাদি জমি আছে, যা আবাদের কাজে ব্যবহার করতে হবে। যাতে কৃষিনির্ভর ব্যবসা–বাণিজ্য গড়ে ওঠে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, সিলেটকে আপাতত প্রবাসীনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রবাসীনির্ভরতা থেকে বের হওয়ার বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করবেন?

করোনার কারণে অনেক প্রবাসী দেশে ফিরেছেন, যাঁদের অনেকেই এখন সংকটে আছেন। সামনে আরও একটি সংকট দেখা দেবে। খুলেই বলি। সিলেট প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা। এখানকার প্রচুর মানুষ ইউরোপ-আমেরিকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তাঁরা সপরিবার শীতকালে দেশে আসেন—এটা দীর্ঘদিনের একটি রেওয়াজ। তাঁরা দেশে তিন–চার মাস কাটান। এ সময়ে ছোট-বড় ব্যবসায় প্রবাসী বিনিয়োগ হয়, জমি কেনাবেচা হয়, ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়, নতুন নতুন ব্যবসা গড়ার সিদ্ধান্তও হয়। কিন্তু করোনার কারণে এবার শীতকালে প্রবাসী পরিবারগুলো দেশে আসতে পারবে না বা আসবে না। এটি সিলেট শহরের হোটেল-মোটেল, আবাসিক এলাকা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা, অশনিসংকেতই বলা যায়। সে জন্য প্রবাসীনির্ভরতা কমানোর প্রস্তুতিও থাকা দরকার।