প্রান্তিক খামারিরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত

মো. দেলোয়ার হোসেন
মো. দেলোয়ার হোসেন
খাদ্যমান নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক চলছে। বিএসটিআইয়ের মান পরীক্ষায় প্রথম দফায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি ৫২টি পণ্য। পাস্তুরিত তরল দুধে অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসা কেন, তার জবাব দিয়েছেন মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. দেলোয়ার হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহমেদ ও শুভংকর কর্মকার।


প্রথম আলো: দুধে ভেজাল কেন?

দেলোয়ার হোসেন: দুধে তো ভেজাল নেই। 

প্রথম আলো: পরীক্ষায় তো অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসা পাওয়া গেল…

দেলোয়ার হোসেন: একটি পরীক্ষায় দুধে ধাতু ও অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কিন্তু সবকিছুর একটা মাত্রা আছে। ধাতু তো বাতাসেও আছে। আমরা যে ধান উৎপাদন করি কিংবা যে চাল খাই, সেখানেও ধাতু থাকে। আমরা কি ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি? দুধে ধাতু থাকতে পারে। তবে পরিমাণটি কত, সেটি জানা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের পরীক্ষায় দুধে চারটি অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে বলে বলা হচ্ছে। তার মধ্যে অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও লিবোফ্লক্সাসিন আমরা গরুর চিকিৎসায় ব্যবহার করি না। অন্য দুটি অ্যান্টিবায়োটিক টেট্রাসাইক্লিন ও সিপ্রোফ্লক্সাসিন গরুর চিকিৎসায় ব্যবহার করি। তার কিছুটা দুধের মধ্যে আসতে পারে। এটি ন্যাচারাল। কিন্তু সেটি আসাটা কতটুকু, সেটি বিবেচ্য বিষয়। আমরা নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুধ পরীক্ষা করিয়েছি। 

প্রথম আলো: আপনাদের পরীক্ষায় কী পাওয়া গেল? 

দেলোয়ার হোসেন: বিসিএসআইআরের মাধ্যমে আমরা যে পরীক্ষা করিয়েছি, সেখানে দুধে টেট্রাসাইক্লিন শনাক্তকরণ মাত্রার নিচে পাওয়া যায়। তার মানে এই অ্যান্টিবায়োটিকের পরিমাণটি খুবই কম। অন্যদিকে পরীক্ষায় সিপ্রোফ্লক্সাসিন প্রতি কেজিতে ২৯ দশমিক ৬৪ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে, যা সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। ১০০ মাইক্রোগ্রাম হলে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতো। তবে আতঙ্কের কারণে খামারি ও ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যে পরীক্ষা করেছে সেখানে দুধে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে মাত্র দশমিক ০০০০৫ পিপিএম, যা সহনীয় মাত্রার অনেক নিচে। এ ক্ষেত্রে দশমিক ২ পিপিএম হলে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতো। এ ছাড়া আমরা এসজিএসের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের একটি পরীক্ষাগারে গত মাসে দুধ পরীক্ষা করেছি। সেখানে অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসা শনাক্তকরণ মাত্রার নিচে পাওয়া যায়। 

প্রথম আলো: দুধে অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসার উপস্থিতির কারণে ভোক্তারা কি আতঙ্কিত? ব্যবসা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? 

দেলোয়ার হোসেন: ভোক্তারা অবশ্যই আতঙ্কিত। আমাদের পরিসংখ্যান তা–ই বলছে। আগে আমরা প্রতিদিন ১ লাখ ৩০ হাজার লিটার দুধ বিক্রি করতাম। সাম্প্রতিক সময়ে তা ৭৫ হাজার লিটারে নেমে এসেছে। ২৮ জুলাই হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর আমরা এক দিন দুধ বিক্রি করতে পারিনি। পরদিন সেই নিষেধাজ্ঞার ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়ার পর থেকে আবার বিক্রি একটু একটু বাড়ছে। বর্তমানে ৯০–৯৫ হাজার লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে প্রতিদিন। দুধ বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে প্রান্তিক খামারিরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের তো প্রতিদিনই গরুকে খাবার দিতে হয়। 

প্রথম আলো: মিল্ক ভিটার কত খামারি আছেন? 

দেলোয়ার হোসেন: আমাদের খামারি আছেন ১ লাখ ২৩ হাজার। ৩ হাজার ৮৪টি সমবায় সমিতির মাধ্যমে তাঁরা মিল্ক ভিটায় দুধ সরবরাহ করেন। খামারিরা প্রতি লিটার দুধের দাম পান গড়ে ৪০ টাকা। 

প্রথম আলো: দুধ সংগ্রহে আপনাদের কোনো নজরদারি কি আছে? 

দেলোয়ার হোসেন: খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহের জন্য ৪৮টি কেন্দ্র আছে। সেখানে একজন ভেটেরিনারি সার্জন আছে। ল্যাব টেকনিশিয়ান আছে। প্রত্যেক খামারির দুধ সংগ্রহ করার সময় ডিটারজেন্ট, ক্ষার ইত্যাদির উপস্থিতি আছে কি না, তা আমরা পরীক্ষা করি। মানসম্মত না হলে দুধ সঙ্গে সঙ্গেই খামারিদের ফেরত দেওয়া হয়। সেই দুধ যখন আবার কারখানায় আসে তখন আরেক দফা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হয়। বাজারে ছাড়ার আগেও আমরা প্রতি ব্যাচ (১০ হাজার লিটার) অনুযায়ী দুধ পরীক্ষা করি। বিষয়গুলো ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা তদারকি করেন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। 

প্রথম আলো: অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসামুক্ত দুধ উৎপাদনে খামারিদের সচেতন করতে মিল্ক ভিটা কোনো উদ্যোগ কি নিয়েছে? 

দেলোয়ার হোসেন: খামারিদের সচেতন করছি আমরা। গরুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর পর ৫–৭ দিন যেন দুধ বিক্রি না করা হয়, সে জন্য আমরা খামারিদের সতর্ক করছি। 

প্রথম আলো: চলতি অর্থবছরের বাজেটে গুঁড়া দুধের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। প্রান্তিক খামারিদের সুবিধা দিতেই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে সরকার। খামারিরা কি উপকৃত হচ্ছেন? 

দেলোয়ার হোসেন: আসলে একে কেন্দ্র করেই এত সব ঘটনা ঘটে গেল। গুঁড়া দুধের ওপর শুল্ক বাড়ানোর ফলে আমদানিকারকদের বাজার কমে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। সেটি যেন না হয় সে জন্যই একটি মহল তরল দুধ নিয়ে প্রপাগান্ডা ও আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করে, যাতে তরল দুধের বিক্রি কমে যায়।