বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে, ভারত যেখানে পিছিয়ে

ভারতে তোলপাড়, বাংলাদেশে আত্মতৃপ্তি। আইএমএফের এক প্রতিবেদন নিয়েই সব আলোচনা। বাংলাদেশ তো আগেই জিডিপিতে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। এবার মাথাপিছু জিডিপিতে পেছনে ফেলতে যাচ্ছে ভারতকে। ভারত কেন পিছিয়ে পড়ল, তার চেয়েও বড় আলোচনা, বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে গেল। করোনার এই মহামারির মধ্যে এটি একটি সুসংবাদ। আর সামনের চ্যালেঞ্জ তো আছেই। সংকট কেটে যাবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে—এই আকাঙ্ক্ষাই এখন সবার।

ছবি: প্রথম আলো

ক্রিকেটে ভারতকে বেশ কয়েকবার হারিয়েছে বাংলাদেশ। ফুটবলেও মাঝেমধ্যে জিতে এসেছে। খেলার বাইরেও সাফল্য আছে। বেশ কিছু সামাজিক সূচকে ভারতকে হারিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। সবশেষ জয়টা আসল অর্থনীতিতে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২০ সালে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে হারিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ।

ব্যবধান যদিও খুব কম। কিন্তু পিছিয়ে পড়ার পর ভারতে এ নিয়ে অর্থনীতি ও রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত সপ্তাহে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, ২০২০ পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার, আর ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৭৭ ডলার।

ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশ এখন। মোট জিডিপির দিক থেকে বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের একটি ভারত। মোট জিডিপির দিক থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অংশ ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ, আর বাংলাদেশের অংশ দশমিক ৩৪ শতাংশ। সুতরাং এ দিক থেকে তুলনাই চলে না। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের অর্থনীতি ১০ গুণ বড়। সুতরাং এত বড় এক অর্থনীতির দেশকে মাথাপিছু আয়ে পেছনে ফেলে দেওয়ার খবর এ কারণেই হয়তো অনেক বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মোদিবিরোধী শিবির প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য মোক্ষম এক অস্ত্র পেয়ে গেছে। ফলে ভারত সরকারকে এখন নানাভাবে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর টুইটের কথা এখানে বলা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘আইএমএফের প্রাক্কলন দেখাচ্ছে যে ২০২১ সালে বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। যেকোনো উদীয়মান অর্থনীতির ভালো করাটা সুসংবাদ। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, পাঁচ বছর আগেও যে ভারত ২৫ শতাংশ বেশি এগিয়ে ছিল, সেই ভারত এখন পিছিয়ে যাচ্ছে। এখন ভারতের প্রয়োজন একটি সাহসী আর্থিক ও মুদ্রানীতি তৈরি করা।’

ভারত কেন পিছিয়ে

বাংলাদেশ যেভাবে আগাচ্ছে আর ভারত কেন পিছিয়ে—এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। দেওয়া হচ্ছে নানা ব্যাখ্যা। ভারতের গণমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস ভারতের পিছিয়ে যাওয়ার জন্য তিনটি কারণের কথা বলেছে।

১. ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বেশি দ্রুত হারে এগিয়েছে। তবে এ সময়ে ভারত এগিয়েছে আরও দ্রুত গতিতে। আর এই প্রবণতা বজায় ছিল ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ব্যবধান কমেনি। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে ২০১৭ থেকে। এর পর থেকে ভারতের অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়া শ্লথ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে আগের চেয়েও দ্রুততার। সঙ্গে এর প্রভাব পড়েছে জিডিপির মাথাপিছু হিসাবে।

২. গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল কম, ভারতের বেড়েছে অনেক বেশি হারে। যেমন ১৫ বছরে ভারতের জনসংখ্যা বেড়েছে ২১ শতাংশ, আর একই সময়ে বাংলাদেশের বেড়েছে ১৮ শতাংশ। আমরা জানি, জিডিপিকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেই মাথাপিছু জিডিপির হিসাব পাওয়া যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির তারতম্যের কারণেই দুই দেশের মধ্যে ব্যবধান এমনিতেই কমে আসছিল। অথচ ২০০৭ সালেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ভারতের অর্ধেক। আর যদি ২০০৪ সালের হিসাব নেওয়া হয়, তাহলে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ছিল বাংলাদেশের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি। এই ব্যবধান গত কয়েক বছরে দ্রুত কমিয়ে আনতে পেরেছে বাংলাদেশ। আর কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারণে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।

৩. কোভিড-১৯-এর প্রভাব দুই দেশের জন্য সমান হয়নি। মহামারির এ সময়ে অর্থনীতিতে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের একটি ভারত। অন্যদিকে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে ভালো করছে। যেমন আইএমএফের হিসাবে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, আর ভারতের প্রবৃদ্ধি কমবে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ ভারতের অর্থনীতি অতিমাত্রায় সংকুচিত হবে বলেই এর প্রভাব পড়ছে মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে

পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়ার পর দ্রুত বিকাশের জন্য বাংলাদেশকে দীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছে। বাংলাদেশের সামনে সুযোগ ছিল সবকিছু নতুন করে শুরু করার। তবে লড়াইটা সহজ ছিল না। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রথম প্রতিবেদনটি ছিল ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। সেখানে বলা হয়, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। এখানকার মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র, মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলারের মধ্যে, যা গত ২০ বছরে বাড়েনি, জনসংখ্যার প্রবল আধিক্য এখানে, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ৪০০ মানুষ বাস করে, তাদের জীবনের আয়ুষ্কাল অনেক কম, এখনো তা ৫০ বছরের নিচে, বেকারত্বের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে এবং জনসংখ্যার বড় অংশই অশিক্ষিত।’

গবেষকেরাও খুব সদয় ছিলেন না বাংলাদেশের প্রতি। যেমন নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং মার্কিন অর্থনীতিবিদ জে আর পার্কিনসন ১৯৭৬ সালে লন্ডন থেকে বাংলাদেশ দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট নামের একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। সেই বইয়ে তাঁরা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নয়নের একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে যেকোনো দেশই উন্নতি করতে পারবে।’

মহামারির এ সময়ে অর্থনীতিতে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের একটি ভারত।
ছবি: রয়টার্স
দা ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস-এ গত ১৭ অক্টোবর প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন জিডিপির দিক থেকে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি শিল্প ও সেবা খাতনির্ভর। এই খাতই এখন কর্মসংস্থান তৈরি করছে, যা কৃষি খাত করতে পারছে না। অন্যদিকে, ভারত শিল্প খাতকে চাঙা করতে হিমশিম খাচ্ছে আর মানুষ এখনো অনেক বেশি কৃষি খাতনির্ভর।

সেই বাংলাদেশ পাকিস্তানকে আগেই ছাড়িয়ে গেছে। আর এখন তো ভারতকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ভারতের বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে শ্রমশক্তিতে নারীদের উচ্চতর অংশগ্রহণ একটি বড় ভূমিকা রাখছে। আর এখানেই ভারত যথেষ্ট পিছিয়ে। আর শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। এই পোশাক খাতকে নিয়েই বিশ্ববাজারে একটি ভালো স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। হিসাব বলছে, শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণের হার ৩২ শতাংশ, আর ভারতে তা মাত্র ২০ দশমিক ৩ শতাংশ।

দা ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস-এ গত ১৭ অক্টোবর প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন জিডিপির দিক থেকে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি শিল্প ও সেবা খাতনির্ভর। এই খাতই এখন কর্মসংস্থান তৈরি করছে, যা কৃষি খাত করতে পারছে না। অন্যদিকে, ভারত শিল্প খাতকে চাঙা করতে হিমশিম খাচ্ছে আর মানুষ এখনো অনেক বেশি কৃষি খাতনির্ভর। এর বাইরে আরও কিছু সামাজিক সূচকও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। যেমন স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ। এখানে একটি ভালো উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। যেমন স্যানিটেশনের দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় পিছিয়ে। অথচ অনিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের কারণে যে মৃত্যুহার, তা ভারতে বেশি, বাংলাদেশে কম।

বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ

মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া এবারই কিন্তু প্রথম নয়। ১৯৯১ সালে একবার বাংলাদেশ এগিয়ে গিয়েছিল। ওই বছর ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ শতাংশ। এক বছর পরই অবশ্য ভারত আবার এগিয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এবারও কি তাহলে এগিয়ে যাবে?

এবার বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়লেও আগামী বছরেই ভারত ঘুরে দাঁড়াবে।
ছবি: রয়টার্স
এবার বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়লেও আগামী বছরেই ভারত ঘুরে দাঁড়াবে। যেমন ২০২১ সালে ভারতের প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ডলারের বিপরীতে মাথাপিছু জিডিপি বাড়বে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

এর উত্তর অবশ্য আইএমএফের প্রতিবেদনেই আছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে বলছে, এবার বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়লেও আগামী বছরেই ভারত ঘুরে দাঁড়াবে। যেমন ২০২১ সালে ভারতের প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ডলারের বিপরীতে মাথাপিছু জিডিপি বাড়বে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। ফলে আগামী বছর ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২ হাজার ৩০ ডলারে উন্নীত হবে, যেখানে বাংলাদেশের ১ হাজার ৯৯০ ডলার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এটা ঠিক, গত কয়েক বছরে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতের সঙ্গে ব্যবধান অনেক কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। আবার পিছিয়ে পড়লেও আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশ ভারতকে চ্যালেঞ্জ দিতেই থাকবে।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে আসলে আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন

কেননা, দারিদ্র্যের হারের দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় খারাপ অবস্থানে আছে। কোভিড-১৯-এর কারণে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি হারে বাড়বে বাংলাদেশে। আবার বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির বড় সমালোচনা হচ্ছে, এটি কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। ফলে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সে তুলনায় কর্মসংস্থান বাড়েনি। আবার মূল্যস্ফীতির দিক থেকেও বাংলাদেশ সহনীয় স্থানে তেমন নেই। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বাড়ার প্রবণতা রয়েছে। সুতরাং অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সামনে। সামনে এগিয়ে যেতে হলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে।