বাতিলের ঝুঁকিতে ২৫৮ এনজিও

বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পর থেকে বিদেশি অনুদান কমেছে। তাই এনজিও পরিচালনা এখন কঠিন। অনেকে পেশা ছেড়ে চলে গেছেন।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়নের আবেদন না করায় রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন বাতিলের ঝুঁকিতে পড়েছে ২৫৮টি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)। এমনকি নিবন্ধনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও তারা নবায়নের জন্য আবেদন করেনি। এসব এনজিওকে নবায়নের আবেদন করতে ৬০ কর্মদিবস সময় বেঁধে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এনজিও ব‌্যুরো। এই সময়ের মধ্যে নিবন্ধন নবায়ন না করলে তাদের নিবন্ধন বাতিল করা হবে।

এনজিও ব‌্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বিদেশি অনুদান পায় এমন আড়াই হাজার এনজিও’র নিবন্ধন আছে। শর্ত অনুযায়ী নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস আগেই তা নবায়নের জন্য আবেদন করতে হয়। এই সময়সীমা মানেনি ২৫৮টি এনজিও। এমনকি মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তারা নিবন্ধন নবায়নের আবেদন করেনি। তবু এসব তাদের নিবন্ধন বাঁচিয়ে রাখতে একটি সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এনজিও ব‌্যুরো গত ১০ ডিসেম্বর এসব এনজিওকে চিঠি দিয়ে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে নিবন্ধন নবায়নের আবেদন করতে বলেছে। সময় শেষ হবে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। শর্ত হচ্ছে, যেসব এনজিওর পাঁচ হাজার ডলারের সমপরিমাণ (বাংলাদেশের প্রায় সোয়া চার লাখ টাকা) বিদেশি অনুদান পাবে এমন প্রতিশ্রুতিপত্র আবেদনের সঙ্গে জমা দিতে পারবে তারাই নিবন্ধন নবায়নের সুযোগ পাবে।

জানতে চাইলে এনজিও ব্যুরোর মহাপরিচালক (ডিজি) রাশেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২৫৮টি এনজিও চিহ্নিত করেছি, যারা দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশ থেকে কোনো অনুদান আনেনি। এ ছাড়া নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তারা নবায়নের জন্য আবেদন করেনি। অথচ এসব এনজিও নিবন্ধন করেছিল বিদেশি অনুদান আনার জন্য। তারা যাতে বিদেশি অনুদান আনতে পারে, সেই তাগিদ দিতেই নিবন্ধন নবায়নের জন্য তাদের অনুরোধ করা হয়েছে।’

নিবন্ধন বাতিলের ঝুঁকিতে থাকা অন্তত দশটি এনজিওর কর্ণধারদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁরা জানান, বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ ঘােষণার পর থেকেই বিদেশি অনদান কমতে থাকে। তাই অনুদান চাইতে গেলে বলা হয়, তোমরা বড় লোক হয়ে গেছো। তোমাদের এখন আর টাকার প্রয়োজন নেই। দাতাদের নজর এখন আফ্রিকার দেশগুলোতে।

জানতে চাইলে ১৯৯৭ সালে নিবন্ধন পাওয়া সেন্টার ফর ‌অ্যাডভান্স রিসার্চ ইন ন্যাচারাল রিসোর্চ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের (কারিনাম) নির্বাহী পরিচালক শেখ মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ বলেন, ‘বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর থেকেই অনুদানের পরিমাণ কমতে থাকে। বিদেশ থেকে এখন আর অনুদান পাওয়া যায় না। আমার এনজিওতে এখন একটি প্রকল্পও নেই। একসময় সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ (ইউএই) বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর অনুদান পেয়েছি।’

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা কারিনামের নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘আমার এখানে যারা কাজ করতো তারা চলে গেছে। বেতন দিতে পারছি না। আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাই এনজিও নবায়ন করছি না। করে কী লাভ? কারণ, বিদেশ থেকে তো অনুদান মিলছে না।’

গণ উন্নয়ন সোসাইটি নামের আরেকটি এনজিওর নির্বাহী পরিচালক এইচ এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক সময় প্রতি মাসে দুই কোটি টাকার বাজেট ছিল আমার। কিন্তু সে অবস্থা নেই। জার্মানি, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অনুদান মিলতো। এখন অনুদানের জন্য আবেদন করলে বলে, তোমরা বড় লোক হয়ে গেছ। তোমাদের আর টাকার দরকার নেই। তাদের নজর এখন আফ্রিকার দেশগুলোর দিকে।’

এদিকে এনজিও ব্যুরোর এমন উদ্যোগের সমালোচনা করে ডেভেলপমেন্ট অব এনভায়রনমেন্ট এডুকেশন অব হিউম্যান সোসিও ইকোনমিক অ্যাসিসট্যান্সের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল কাইয়ুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন বিদেশ থেকে অনুদান নেওয়ার সক্ষমতা আমার নেই। তবে আমার তো একসময় সামর্থ্য হতেও পারে। আগে আমি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর বিদেশি অনুদান পেয়েছি। আবার হয়তো আমি প্রকল্প পাব। যদি দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে আমি কাজ করবো কীভাবে? আমি চাই না আমাদের জন্য দরজা বন্ধ হোক।’

একটি এনজিওর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সোহেলী রহমান জানান, এনজিও ব্যুরো যে উদ্যোগ নিয়েছে সে সম্পর্কে তিনি এখনো জানেন না। তবে গত পাঁচ বছর ধরে তিনি বিদেশি কোনো অনুদান পাননি জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর থেকে কেউ অনুদান দিতে চায় না।

নিবন্ধন ঝুঁকিতে পড়া এনজিওর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল—এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, একতা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ একাডেমি ফর এগ্রিকালচার, বাংলাদেশ ডায়নামিক সােসাইটি, বাংলাদেশ হেলথ ফাউন্ডেশন, কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ, ডেভেলপমেন্ট ফর দ্য পুওর।