ভুল মানুষের কাছে ভাতা চলে যাচ্ছে

প্রথম আলো ফাইল ছবি

সরকার বন্যার সময় ত্রাণ দিচ্ছে, আবার বছরজুড়ে অনেক বয়স্ক মানুষকে ভাতাও দিচ্ছে, কিন্তু পরিমাণের দিক থেকে এসব অপ্রতুল বলে মনে করেন তৃণমূলের উন্নয়নকর্মীরা। পাশাপাশি বয়স্ক মানুষের পক্ষে ভাতা নিতে ব্যাংকে যাওয়া কঠিন। বয়স্ক ভাতার টাকা ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিতরণের পরামর্শ দেন তাঁরা। এ সময় জানানো হয়, এখন যাঁরা ভাতা পাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত ১৯-২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র নয়।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), অক্সফাম ইন বাংলাদেশ ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক কমিটির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত গতকাল বুধবার ভার্চ্যুয়াল সংলাপে বক্তারা বলেন, দেশে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রতিবছর বরাদ্দ বাড়ছে। তবে যাঁদের প্রয়োজন, তাঁরা যতটা না পাচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি পাচ্ছেন সেই মানুষেরা, যাঁদের প্রয়োজন কম। ভাতাগ্রহীতা নির্বাচনে ব্যাপক ভুলভ্রান্তি যেমন আছে, তেমনি দুর্নীতিও আছে। সে জন্য জাতীয় তথ্যভান্ডার দরকার বলে মনে করেন বক্তারা।

ভাতাভোগী নির্বাচনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের দেশপ্রেমের পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানান সাংসদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এ বি তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, যত দিন না সব গরিব মানুষকে ভাতার আওতায় নিয়ে আসা যায়, অন্তত তত দিন এই তালিকা প্রণয়নে সততার পরিচয় দিতে হবে। পাশাপাশি এই কাজ সুচারুভাবে করার জন্য তথ্যভান্ডার তৈরির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন তিনি। সব মানুষের ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিত করতে হবে বলে মত দেন তিনি।

সে জন্যই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। তাজুল ইসলাম মনে করেন, এই গবেষণা প্রতিবেদন সরকারের কার্যক্রমের জন্য সহায়ক হবে। প্রতিবেদনটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় বিবেচনা করবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্যাপারে প্রশাসন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, জনপ্রতিনিধি—সবাই এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন। সরকার মধ্যমেয়াদি সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন করেছে। ফলে দেশে নীতিগত পরিসর ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে।

সরকার প্রতিবছর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ালেও তা এখনো পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। দেশের মানুষকে এখনো যত রকম বিপন্নতা ও ভঙ্গুরতার মধ্যে জীবন যাপন করতে হয়, তাতে এসব বরাদ্দ আরও বাড়ানো দরকার। এখানে সরকারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজার অর্থনীতি এই সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। বিষয়টি এখন বারবার সামনে চলে আসছে। তাঁর মত, এই পরিস্থিতিতে সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। এর জন্য জাতীয় তথ্যভান্ডার দরকার বলে তাঁর মত।

সংলাপটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির গুরুত্ব অনেক। সবচেয়ে বড় কথা, তৃণমূলের উন্নয়নকর্মী, জনপ্রতিনিধি, জ্ঞান অংশীদার, রাজনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী—সবাই একত্র হওয়ায় এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মাঠের বাস্তবতা সম্পর্কে জানা গেল। আবার তাঁরাও জানলেন, কী করা যেতে পারে। সে জন্য এই মিথস্ক্রিয়া জরুরি।

অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনা, পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দ সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছায় না। এখন যাঁরা ভাতা পাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত ১৯-২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র নয়। ফলে এই চার কর্মসূচি যে দরিদ্র মানুষের কাজে লাগছে, তেমনটা বলা যাচ্ছে না।

তৌহিদুল ইসলাম খান আরও বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকারের বরাদ্দের পরিমাণও কম। সে কারণে টার্গেটিং বা ভাতাভোগী নির্বাচনে আরও দক্ষতার পরিচয় দেওয়া দরকার বলে তিনি মত দেন। পাশাপাশি এসব কর্মসূচির তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। সাধারণত যাঁরা আগে ভাতা পেয়েছেন এবং চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছের মানুষ, তাঁরাই এর খোঁজখবর পান। অন্যদের পক্ষে এই খবর পাওয়া কঠিন—এটাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ ছাড়া ভাতাভোগী নির্বাচনে সরকারের সব নির্দেশনা অনুসরণ করা হয় না। হতদরিদ্র ও দরিদ্ররা একই হারে ভাতা পান।

অধ্যাপক আবু ইউসুফ মনে করেন, এটা ঠিক নয়, হতদরিদ্রদের ভাতার পরিমাণ বেশি হওয়া উচিত। এ ছাড়া দেশের সামাজিক নিরাপত্তা মূলত গ্রামীণ দরিদ্রদের কথা মাথায় রেখে করা হয়েছে, যদিও নগর দরিদ্রদের বিপণ্নতা বেশি। তাঁদের দিকেও নজর দেওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি।

মূলত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পাঁচটি খাত নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে—মাতৃত্বকালীন ভাতা, প্রাথমিক স্কুল ও মাধ্যমিক স্কুল কর্মসূচি, অতিদরিদ্র কর্মসংস্থান কর্মসূচি ও বয়স্ক ভাতা। যে চারটি জেলায় গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে, সেগুলো হলো কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা ও নীলফামারী। ভার্চ্যুয়াল সংলাপে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ ছাড়া নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।