মজুরি সূচক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনার প্রভাবে গত দুই মাসে অর্থনীতি প্রায় বিপর্যস্ত। সবকিছু বন্ধ থাকায় শ্রমিকের চাহিদা কমেছে। ফলে কাজ হারিয়েছেন হাজার হাজার দিনমজুর। বহু পরিবারের আয় কমেছে। এতে সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের হারও বেড়েছে। এই দুঃসময়ে গরিব মানুষকে সহায়তা দিতে নানা ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে ভিন্ন কথা। সংস্থাটির সর্বশেষ মজুরি হার সূচক বলছে, গত এপ্রিল ও মে মাসে জাতীয় মজুরি হার বেড়েছে। সংগত কারণেই তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গত এপ্রিল মাসে মজুরি হার ৬ দশমিক ১০ শতাংশ এবং মে মাসে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ গত বছরের এপ্রিলে দিনমজুরেরা গড়ে ১০০ টাকা মজুরি পেলে এ বছরে একই মাসে গড়ে ১০৬ টাকা ১০ পয়সা পেয়েছেন। একইভাবে গত বছরের মে মাসে ১০০ টাকা মজুরি পেলে এ বছরের একই সময়ে তা ১০৫ টাকা ৮৯ পয়সা হয়েছে। অর্থাৎ এবারে মজুরি বেড়েছে।

এদিকে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি হলে কারও কাছে হাত পাততে হয় না। নিজেদের ক্রয়ক্ষমতা দিয়েই বাজার থেকে বেশি দামে পণ্য কেনা যায়।

গত এপ্রিল ও মে মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ওই দুই মাসের মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি। মূল্যস্ফীতি এপ্রিলে ছিল ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং মে মাসে হয়েছে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বিবিএসের হিসাব ধরলে, দিনমজুরদের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজার থেকে বেশি দামে তাঁদের পণ্য কিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি; বরং কর্মহীন হয়ে যাওয়া গরিব মানুষের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের সহায়তা কর্মসূচি নিতে হচ্ছে।

 এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতি শাস্ত্রের কোনো যুক্তিতেই বিবিএসের মজুরি হার বৃদ্ধির ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। সাধারণত যখন শ্রমিকের চাহিদা বাড়ে, সরবরাহ কম থাকে, তখন মজুরি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু গত দুই মাসে প্রায় সবকিছুই বন্ধ থাকায় শ্রমিকের চাহিদা বেশ কমেছে। অনানুষ্ঠানিক খাতে বেকারের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। গত দুই মাসে শুধু বোরো ধান কাটার জন্য হাওর ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে শ্রমিকদের চাহিদা বেড়েছিল। তাহলে গত দুই মাসে মজুরি বাড়ল কোন ভিত্তিতে?

>

বিবিএস বলছে, এপ্রিল ও মে মাসে মজুরি হার বেড়েছে। কিন্তু এই তথ্য বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।

জাহিদ হোসেন বলেন, মজুরি যদি বাড়ত, তাহলে এই করোনাকালে সরকারকে এত সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিতে হতো না। বিবিএস অতীতের মজুরি বৃদ্ধির প্রবণতা দেখে পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণ করে এই তথ্য দিয়েছে, যা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়।

বিবিএস প্রতি মাসে কৃষিশ্রমিক, পরিবহনকর্মী, বিড়িশ্রমিক, জেলে, দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিকসহ ৪৪ ধরনের পেশাজীবীর মজুরির তথ্য সংগ্রহ করে মজুরি হার সূচক তৈরি করে। এসব পেশাজীবীর মজুরি খুব কম এবং দক্ষতাও কম। শুধু দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি পান কিংবা নগদ টাকার পরিবর্তে অন্য সহায়তা (কাইন্ড) পান, তার ভিত্তিতে কোন মাসে মজুরি হার কত বাড়ল, তা প্রকাশ করে বিবিএস। অথচ করোনায় ওই সব শ্রমিকই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

 বিবিএস যে ৪৪ ধরনের পেশাজীবীর মজুরির তথ্য নেয়, তার মধ্যে ২২টি শিল্প খাতের এবং ১১টি করে কৃষি ও সেবা খাতের পেশা। বেতনভোগী কিংবা উচ্চ আয়ের পেশাজীবীদের বিবিএসের মজুরি সূচকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

বিবিএসের ওই ৪৪ ধরনের পেশাজীবীদের মধ্যে ২২ টি শিল্প খাতের এবং ১১ টি করে কৃষি ও সেবা খাতের পেশা আছে । বেতনভোগী কিংবা উচ্চ আয়ের পেশাজীবীরা বিবিএসের মজুরি সূচকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

 করোনাকালে মজুরি হার বাড়ল কীভাবে—এই প্রশ্ন জাতীয় মজুরি হার সূচক তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিবিএসের জাতীয় আয় শাখার একাধিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, মাঠপর্যায়ে যে তথ্য পাওয়া গেছে, এর ভিত্তিতে মজুরি সূচকের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

করোনাকালে দিন আনে দিন খায় এমন মানুষের আয় কমে যাওয়ার বিষয়টি দেশের একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে।

 বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এপ্রিল মাসে অতি গরিব, গরিব, গরিব হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষ এবং গরিব নয় এমন মানুষের দৈনিক আয় ৬৫ থেকে ৭৫ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে গরিব মানুষের আয় ৭৫ শতাংশ ও অতি গরিবের আয় ৭৩ শতাংশ কমেছে। আয় কমে যাওয়ায় সার্বিকভাবে ২৩ শতাংশ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে।

 আরেক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসাবে, করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৯ সাল শেষে দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। করোনাকালে আয়বৈষম্যও বেড়েছে বলে মনে করে সিপিডি।

 গবেষণা সংস্থাগুলোর গবেষণা প্রতিবেদনে করোনাকালে সমাজের সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা মানুষের আয় বা মজুরি কমার তথ্য উঠে এলেও বিবিএসের জাতীয় মজুরি হার সূচকে উল্টো চিত্র দেখা যায়। সে জন্য সরকারি সংস্থাটির তথ্য-উপাত্তের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে।