মালিকদের উদ্যোগ পর্যাপ্ত ছিল না

তাজরীনের আহত শ্রমিকদের একাংশ ৭০ দিন ধরে জাতীয় প্রেসক্লাবে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। চিকিৎসার ব্যয় ও পুনর্বাসনের দাবিতে তাঁরা আন্দোলন করলেও সরকার বা পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তরফ থেকে কোনো আশ্বাস আসেনি। কেন শ্রমিকেরা দুর্ভোগে পড়লেন, করণীয় কী—এসব বিষয়ে কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অনুলিখন করেছেন শুভংকর কর্মকার

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

আট বছর ধরে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ উন্নতির দাবি করছি আমরা। তাহলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ৭০ দিন ধরে অনাহারে, অর্ধাহারে তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডে আহত একদল শ্রমিক কী দাবি করছেন? বলা হয়েছিল, তাজরীন দুর্ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবার এবং আহত শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়েছে। তবে কি প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থানরত আহত শ্রমিকেরা অন্যায্য দাবি তুলে ধর্মঘট করছেন?

কাগজে–কলমের হিসাবে এই শ্রমিকদের সঙ্গে দেনা–পাওনা মিটে যাওয়ার দাবি করতে পারে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে বিদেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের উদ্যোগে তাজরীন দাবি নিষ্পত্তি ট্রাস্ট গঠিত হয়। এই ট্রাস্ট সরকারি উদ্যোগ ও সহযোগিতার পাশাপাশি নিজেরা প্রায় ২০ কোটি টাকা ১১৩ জন নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবার এবং ১৭৪ জনের মতো আহত শ্রমিকের মধ্যে বিতরণ করে। ১১৪ জন আহত শ্রমিককে ৮ হাজার ৬১৩টি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বৈঠক, অপারেশন, ফিজিওথেরাপি, হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হয়। ৮৩ জন আহত শ্রমিক নিয়মিত চেকআপ করাচ্ছেন। করোনাকালে এসব চিকিৎসা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে আহত শ্রমিকদের সাহায্যার্থে।

সরকারের তরফ থেকে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদি ভাতার ব্যবস্থা করা দরকার। শ্রমিকদের সন্তানদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বিষয়টিও আলাদাভাবে গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

প্রশ্ন হলো তাহলে আহত শ্রমিকেরা তাঁদের চিকিৎসা ও কাজের জন্য কেন দাবি তুলছেন? সত্য কথা হলো, এ পর্যন্ত যা করা হয়েছে, তা গুরুতর আহত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এ ক্ষেত্রে তাজরীনে আহত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। আশা করছি, তাজরীনের জন্য গঠিত ট্রাস্ট অনতিবিলম্বে বিজ্ঞপ্তি, চিঠি, জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে আহত শ্রমিকদের যোগাযোগের জন্য অনুরোধ করবে এবং তাঁদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা নেবে। সেই সঙ্গে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রমিকদের জন্য মাসিক আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা নেবে। সরকারের তরফ থেকে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদি ভাতার ব্যবস্থা করা দরকার। শ্রমিকদের সন্তানদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বিষয়টিও আলাদাভাবে গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। সার্বিকভাবে তাজরীনের এই শ্রমিকেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দেশে জরুরি ভিত্তিতে দুর্ঘটনা বিমা ও বেকারত্ব বিমা চালু করা দরকার।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার এবং বিদেশি ক্রেতা ও ব্র্যান্ড অর্থসহায়তা দিলেও পোশাকশিল্পের মালিকদের উদ্যোগ পর্যাপ্ত ছিল না। দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উদ্যোগের অভাবেই তাজরীনের আহত শ্রমিকেরা দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। বাধ্য হয়ে তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন। আবার আইনি দীর্ঘসূত্রতার জন্যও শ্রমিকেরা ন্যায্য বিচার ও ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সে কারণে তাজরীনের চলমান মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।