মূল্যস্ফীতিতে স্বস্তি কমছে

দেশের অর্থনীতিতে আরেকটি চাপ সৃষ্টির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ মূল্যস্ফীতি এখন ৬ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে এত দিন যে স্বস্তি ছিল, তা কিছুটা হলেও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সর্বশেষ দুই মাসে অর্থাৎ গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের আশপাশে থাকায় এমনটা আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে এই হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। সাধারণত নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি—এই তিন মাস মূল্যস্ফীতি কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। ফলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে। কারণ এ সময়ে নতুন চাল বাজারে আসে। আবার বাজারে প্রচুর মৌসুমি শাকসবজি, মাছ ইত্যাদি পাওয়া যায়। কিন্তু এবার এই সময়ে মূল্যস্ফীতি অন্যবারের তুলনায় কিছুটা বেশি। 

গত অর্থবছর শেষ হয়েছিল ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে। তবে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৬২ শতাংশে ওঠে। পরের তিন মাস ওঠানামার মধ্যে ছিল মূল্যস্ফীতি। কিন্তু নভেম্বরে এসেই ২৪ মাস পর হঠাৎ করেই মূল্যস্ফীতি প্রথমবারের মতো ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। পরের মাস ডিসেম্বরে অবশ্য তা কিছুটা কমেছে। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি পৌনে ৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্য রয়েছে। 

মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় মজুরি ও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে আছে। মজুরির পরিমাণও বেশ কম। এ ছাড়া নির্মাণশ্রমিক ও জেলেদের মজুরি বৃদ্ধির হার বেশ কম। এসব কারণে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) উচ্চ প্রবৃদ্ধির সুফল শ্রমিকেরা পাচ্ছেন না। ধনিরা এই সুবিধা বেশি পাচ্ছেন। জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে বিশেষকরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন বাধাহয়ে দাঁড়াচ্ছে।

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, দেশে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধির শঙ্কা আছে। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার ব্যাংক খাত থেকে বিপুল অর্থ ঋণ নিচ্ছে, ভবিষ্যতেও নেবে। কিন্তু ওই সব বড় প্রকল্পের সুবিধা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তি খাতের ঋণও তেমন একটা বাড়ছে না। এ কারণে মূল্যস্ফীতি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে থাকবে না। 

এদিকে ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি কমার কারণ হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, তখন প্রচুর শীতকালীন শাকসবজি বাজারে উঠেছে। আমন ধানও বাজারে এসেছে। বাজারে মাছের দামও বেশ কম ছিল। এসব কারণে ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি কমেছে। 

তবে ডিসেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমলেও তিন মাস ধরে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি টানা বেড়েছে। গত অক্টোবর মাসে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ডিসেম্বর মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৫৫ শতাংশে। 

খাদ্য খাতে ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ হয়েছে। গত নভেম্বর মাসে তা ছিল ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। 

মূল্যস্ফীতির হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যালোচনা করে বিবিএস বলছে, বেগুন, শিম, গাজর, শসা, টমেটো, ফুলকপি, লাউ, পেঁয়াজ ও আদার দাম গত নভেম্বর মাসের তুলনায় ডিসেম্বরে কমেছে। 

বিবিএস বলছে, ডিসেম্বরে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি হয়েছে। এই প্রবণতা খুব একটা দেখা যায় না। গত মাসে শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ, আর গ্রামে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। 

গত ডিসেম্বরে জাতীয় মজুরি সূচকের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। নভেম্বরের চেয়ে ডিসেম্বর মাসে মজুরি বৃদ্ধির গতি কিছুটা বেড়েছে। বিবিএস বলছে, ২০১০-১১ ভিত্তিবছর ধরে গত ডিসেম্বর মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা নভেম্বর মাসে ছিল ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য–উপাত্ত অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতি বাড়লেও তা সাধারণ মানুষের ক্রয়সক্ষমতায় তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। 

মূল্যস্ফীতি হলো সাধারণ মানুষের ওপর একধরনের করের মতো। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে তা বেশি দামে কিনতে হয়। কিন্তু ওই ব্যক্তির আয় না বাড়লে ওই সব জিনিসপত্র কিনতে তাঁর ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।