মেয়াদ প্রায় শেষ, কাজে গতি নেই

  • বিভিন্ন স্থলবন্দরের উন্নয়নে সাতটি প্রকল্প আছে। আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হওয়ার কথা। অথচ এখনো মূল কাজ শেষ হয়নি।

  • বাল্লা, গোবড়াকুড়া–কড়ইতলী, বিলোনিয়া স্থলবন্দরের মূল কাজ শুরু হয়নি।

  • সিলেটের শেওলা ও রামগড় স্থলবন্দরের জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়নি।

  • প্রকল্পগুলোতে কাজের বাস্তবায়ন মাত্র ১%-৩০%।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের বাল্লায় স্থলবন্দর স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয় ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ। সেখানে তখন স্থলবন্দরের কোনো অবকাঠামো ছিল না বললেই চলে। পরের বছর স্থলবন্দরটির অফিস ভবন, গুদাম, ট্রাক পার্কিং, দেয়াল নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো সুবিধা তৈরির জন্য প্রায় ৪৯ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা। কিন্তু চার বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের তিন বছর পার হয়ে গেছে। অথচ এখনো জমি অধিগ্রহণের কাজই শেষ হয়নি।

একাধিক মামলা-মোকদ্দমাসহ নানা জটিলতায় জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করতে পারেনি বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। ফলে প্রকল্পের মূল কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ১৪ শতাংশ। খরচ হয়েছে মাত্র ৭ কোটি টাকা।

বর্তমানে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের আওতায় সাতটি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। সব কটি প্রকল্পের প্রায় একই দশা। আগামী জুন মাসের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, কাজ যেমন এগোয়নি, তেমনি এ বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (এডিপি) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কম। ফলে প্রকল্প শেষ করা যাবে না।
অথচ ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য সহজ করার লক্ষ্যে তিন-চার বছর আগে

বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এ রকম সাতটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পে এ পর্যন্ত শুধু জমি অধিগ্রহণ করতে পেরেছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া সামনে আর কোনো গতি নেই। আর মেয়াদ বাড়ালে অবধারিতভাবে খরচ বাড়বে।

স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন ঘটিয়ে দ্রুত চালু করা হলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আরও সহজ হবে। ভারতের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে দ্রুত, সহজে ও সস্তায় পণ্য চলে আসতে পারবে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান

এদিকে একের পর এক স্থলবন্দর ঘোষণা করা হচ্ছে। গত ১০ বছরে ১০টি স্থলবন্দর স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ২৪টি স্থলবন্দর ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে মাত্র ১২টি স্থলবন্দর চালু করা সম্ভব হয়েছে। জনবল ও অবকাঠামোর অভাবে বাকিগুলোর কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। ফলে সীমান্ত বাণিজ্য সহজ হচ্ছে না।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন ঘটিয়ে দ্রুত চালু করা হলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আরও সহজ হবে। ভারতের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে দ্রুত, সহজে ও সস্তায় পণ্য চলে আসতে পারবে। আবার যেতেও পারবে। ফলে দু–একটি স্থলবন্দরের ওপর এখন যে চাপ আছে, তা কমবে। তাঁর মতে, ভারতের সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আদলে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন অবাধ মোটরযান চলাচল চুক্তি। এসব উদ্যোগের অনেকগুলো রুটে এসব স্থলবন্দর অবস্থিত। তাই এসব স্থলবন্দরের কাজ দ্রুত শেষ করা উচিত।

২০১৮ সালে গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নে ৬৭ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পটি আগামী ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। গত দুই বছরে জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে।

গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী

ভারতের মেঘালয়ের গাছুয়াপাড়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে গোবড়াকুড়া-কড়ুইতলীতে স্থলবন্দর নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয় ২০১০ সালে। সেখানে অবকাঠামো, গুদামঘর, অফিস, প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি কিছুই ছিল না। ফলে স্থলবন্দর হিসেবে কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।

এমন অবস্থার আট বছর পর ২০১৮ সালে এই স্থলবন্দরের সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নে ৬৭ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পটি আগামী ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। গত দুই বছরে জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। সার্বিকভাবে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩০ শতাংশ। আগামী তিন মাসে প্রকল্প শেষ করা যাবে না, এটা নিশ্চিত। কারণ, চলতি এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ১০ কোটি টাকা।

ত্রিপুরার সঙ্গে বাণিজ্য সহজ করতে ২০০৯ সালে ফেনীর বিলোনিয়া শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এখনো স্থলবন্দর হিসেবে কার্যক্রম শুরু হয়নি।

বিলোনিয়া

ত্রিপুরার সঙ্গে বাণিজ্য সহজ করতে ২০০৯ সালে ফেনীর বিলোনিয়া শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এখনো স্থলবন্দর হিসেবে কার্যক্রম শুরু হয়নি। স্থলবন্দর ঘোষণার ৯ বছর পর সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ৩৮ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়।

প্রকল্পটি আগামী জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু এখনো মূল কাজ শুরু হয়নি। শুধু জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। গত জুন মাস পর্যন্ত ৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বাস্তবায়নের হার ২১ শতাংশ। চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরে মাত্র ৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ প্রকল্প শেষ করতে প্রয়োজন ৩০ কোটি টাকা।

ধানুয়া-কামালপুর

২০১৫ সালের মে মাসে জামালপুরের বকশীগঞ্জের ধানুয়া-কামালপুর স্থলবন্দর নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই পথে মেঘালয়ের আমপাতির সঙ্গে বাণিজ্য হবে। অবকাঠামো না থাকায় এই স্থলবন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়নি। তাই অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালে ৫৯ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। জমি অধিগ্রহণ হলেও এখনো মূল কাজ শুরু হয়নি। গত জুন পর্যন্ত অগ্রগতি ১১ শতাংশ। খরচ হয়েছে মাত্র ৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

সিলেটের শেওলা, খাগড়াছড়ির রামগড় ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের উন্নয়ন এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে ২০১৭ সালে ৬৯৩ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। তিন বছরে প্রকল্পের বাস্তবায়ন মাত্র ১০ শতাংশ।

অন্যান্য প্রকল্প

সিলেটের শেওলা, খাগড়াছড়ির রামগড় ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের উন্নয়ন এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে ২০১৭ সালে ৬৯৩ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। তিন বছরে প্রকল্পের বাস্তবায়ন মাত্র ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ২২ শতাংশ।

বেনাপোল স্থলবন্দরে কার্গো ভেহিক্যাল টার্মিনাল নির্মাণের মূল কাজ শুরু হয়নি।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (উন্নয়ন) হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মূলত জমি অধিগ্রহণে মামলা-মোকদ্দমার কারণে দু-তিন বছর চলে যায়। এ ছাড়া প্রকল্প প্রস্তাব অনুসারে এডিপিতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় না।