রাজস্ব ও জনস্বাস্থ্য নয়, তামাক কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধির বাজেট

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এবার একটা মেগা বাজেট পেশ করা হয়েছে। নিরাপত্তাবেষ্টনী বৃদ্ধিকরণ, করপোরেট কর কমিয়ে ব্যবসাকে উৎসাহিত করা, বড় শহরের বাইরে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় ১০ বছরের কর মুক্তিসহ অনেকগুলো ভালো প্রস্তাব থাকলেও স্বাস্থ্য খাতের জন্য উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু নেই এ বাজেটে।

কোভিডের কারণে স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা জনসম্মুখে চলে এসেছে। গত বছর যেহেতু কোভিড আসার কিছুদিনের মধ্যেই বাজেট পেশ করতে হয়েছিল, তাই তেমন কিছু করা যায়নি স্বাস্থ্য বাজেটে। তবে এবার সবার প্রত্যাশা ছিল স্বাস্থ্য খাতের জন্য উল্লেখ করার মতো কিছু প্রস্তাবনা থাকবে। কিন্তু সেটা দেখা যায়নি। জনস্বাস্থ্যও এ বাজেটে উপেক্ষিত। তা না হলে তামাক ও তামাকজাত পণ্য যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ, তার ওপর তেমন কর বৃদ্ধি না করে তামাক কোম্পানির মুনাফাকেই বড় করে দেখা হলো।

এবারের বাজেটের একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো পর্যাপ্ত রাজস্ব আয়ের সংস্থান করা। সরকারের যেমন রাজস্ব আয় নিশ্চিত করতে হয়, একই ভাবে মানুষের যাতে কল্যাণ হয়, তা–ও নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু খুব কম জিনিসই আছে, যার ওপর কর আরোপ করা উভয় দিক থেকেই লাভজনক। সে জন্য তামাকের ওপর একটা সুচিন্তিত কর আরোপ রাজস্ব বৃদ্ধিসহ জনকল্যাণ অর্জনে খুবই সময়োপযোগী হতে পারত।

অনেকে হয়তো ভাববেন, কর বাড়ালে তো সিগারেট বিক্রিও কমে যাবে, তাই কর আয়ও কমে যাবে। তা আসলে মোটেই সত্য নয়। প্রথমত, তামাক একটি নেশাজাতীয় দ্রব্য। তাই কর বাড়ার কারণে দাম বাড়ালেও যে হারে কর বাড়ে, বিক্রি সেই হারে কমে না। যেমনটা ঘটে চালের মতো মৌলিক দ্রব্যের ক্ষেত্রে। একে অর্থনীতির ভাষায় বলে অস্থিতিস্থাপক চাহিদা, অর্থাৎ যার দাম বাড়লেও মানুষ ক্রয় করা তেমন কমায় না।

তামাকও একটি অস্থিতিস্থাপক পণ্য। দ্বিতীয়ত, কর বাড়ালেও কোম্পানিগুলো পুরো কর ভোক্তার ওপর চাপাতে পারেন না বাজার ধরে রাখার স্বার্থে। ফলে কর বাড়ালে কোম্পানির লাভের অংশ কমে, জনগণ বা সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি ও ব্লুমবার্গ ইনিশিয়েটিভ দেখিয়েছেন যে সিগারেটের কর বাড়িয়ে সরকারি রাজস্ব বর্তমান লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা বেশি আয় করা যেতো। এই অতিরিক্ত কর সরকারের মেগা বাজেটের অর্থ জোগানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। আর্থিক চাপে থাকা এ বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সরকারকে এই অতিরিক্ত আয় থেকে কেন বঞ্চিত করল, সেটা একদিকে যেমন রহস্যময়, তেমনি সেটা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন।

শুধু অতিরিক্ত আয়ই নয়, তামাকের ওপর কর বৃদ্ধির আরও অনেক সুফল রয়েছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে দেখা যায়, তামাক ব্যবহারের কারণে সরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে দেশে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা স্বাস্থ্যের পেছনে ব্যয় হয় এবং এই অঙ্ক গতবারের মোট স্বাস্থ্য বাজেট থেকেও বেশি, আর এ বছরের স্বাস্থ্য বাজেটের প্রায় সমান। তা ছাড়া এই তামাকের কারণে দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার লোক অকালে মারা যায়, যারা অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারত। সেই অঙ্ক পুরোপুরি হিসাবে আনলে ক্ষতির মাত্রা আরও কয়েক গুণ বেশি হবে।

তামাকের চাষাবাদ ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি তামাকের পাতা শুকানোর জন্য জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ, বনভূমি উজাড় হওয়া, মাটির উর্বরতা হ্রাস, ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠের পানির দূষণ জড়িত, যা পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া তামাক চাষে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে দেশের জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে। যদি এসব ব্যয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে তামাক চাষের মোট ব্যয় তা থেকে অর্জিত আয় থেকে অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, তামাক চাষের এই পরিবেশগত ক্ষতি আমলে নিলে দেশের জন্য তামাক চাষ অত্যন্ত অলাভজনক।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করবেন। কিন্তু তামাকের কর সেভাবে বৃদ্ধি না করে সরকারেরই আরেক অঙ্গ এ লক্ষ্য অর্জনে বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তামাক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা ছাড়া তামাক কর বৃদ্ধি না করার আর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি ও ব্লুমবার্গ ইনিশিয়েটিভ দেখিয়েছেন, বর্তমান প্রস্তাবিত কর প্রস্তাব বজায় থাকলে তামাক কোম্পানিগুলো ২০২১-২২ সালে ৭০০-৮০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করবে। অথচ জনস্বাস্থ্য খাতে সরকার ও সাধারণ মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

তাই রাজস্ব আয় বাড়ানো, তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে জনস্বাস্থ্য খাতে সাশ্রয়, নেশাজাতীয় পণ্যের ওপর ব্যয় কমানো ও পরিবেশজনিত ক্ষতি কমাতে তামাক কর বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। তামাক কর বৃদ্ধি না করা অত্যন্ত দুঃখজনক। করোনা মহামারিকালেও সরকারের নীতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারের একটি মহলের তামাক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত থাকা শুধু হতাশাজনকই নয়, নজিরবিহীনও বটে।