রিজার্ভের অর্থে হবে সরকারি প্রকল্প

সম্ভাব্য কেলেঙ্কারি ঠেকাতে সতর্কতার সঙ্গে এগোনোর পরামর্শ

  • রিজার্ভ দেশের বাইরে বিনিয়োগ করলে এক বা দুই শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি প্রকল্পে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের ব্যাপারে চিন্তা করছেন—অর্থমন্ত্রী

  • রিজার্ভ এখন ৪ হাজার ২০৯ কোটি ডলার, যা গত এক বছর আগের তুলনায় ১ হাজার কোটি ডলারের বেশি।

  • এশিয়ার উন্নত দেশ জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকংয়ে রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করা যায়—অর্থ বিভাগ

  • বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ অনুযায়ী কোনো প্রকল্পে রিজার্ভ ব্যবহারের সুযোগ নেই।

  • ৫০টির মতো দেশে রিজার্ভের অর্থে সার্বভৌম সম্পদ তহবিল রয়েছে।

শেষ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থ সরকারি প্রকল্পে ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি করছে সরকার। এ নিয়ে নীতিমালা তৈরির কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল বৃহস্পতিবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ভার্চ্যুয়াল বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের আগেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫ হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করবে কয়েক বছরের মধ্যেই। এ রিজার্ভ দেশের বাইরে বিনিয়োগ করলে ১ বা ২ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি প্রকল্পে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের ব্যাপারে চিন্তা করছেন।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ। লেনদেনের ভারসাম্য প্রতিকূল হলে বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার দায় পরিশোধের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে রিজার্ভ। এটি কোনো দেশের বৈদেশিক দায় পরিশোধের অর্থনৈতিক সক্ষমতারও নির্দেশক।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের পর্যবেক্ষণে এসেছে, এশিয়ার কিছু উন্নত দেশে রিজার্ভের অর্থ ব্যবহারের বেশি উদাহরণ রয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকং।

‘টাকায় ফেরত দিলেও সমস্যা নেই; কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক তো টাকা দিয়েই ডলার কেনে। তবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তা ব্যবহার করা না হলে মহা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ওই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২-এর ৭/অ ধারায় বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক বৈদেশিক মুদ্রার ধারণ ও ব্যবস্থাপনার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বাংলাদেশ ব্যাংক একক কোনো মুদ্রায় না রেখে বিভিন্ন মুদ্রায় উচ্চমানের বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্বল্পমেয়াদি আমানতে বিনিয়োগ করছে। এ রিজার্ভ উচ্চমানের সার্বভৌম বা করপোরেট বন্ডেও বিনিয়োগ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভের একটি অংশ দিয়ে সোনাও কিনে রাখা হয়।

দেশের ইতিহাসে সেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন সর্বোচ্চ উচ্চতায়। পরিমাণ ৪ হাজার ২০৯ কোটি ডলার, যা গত এক বছর আগের তুলনায় এক হাজার কোটি ডলারের বেশি। বৈধ পথে দেশে প্রবাসী আয় পাঠাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে সরকার যে ২ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে আসছে, সে কারণেই প্রবাসী আয় আগের তুলনায় বেশি আসছে দেশে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) এসেছে দেশে। আগের অর্থবছরের তুলনায় তা প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বেশি। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২১১ কোটি ডলার।

আরও পড়ুন

রিজার্ভের অর্থ বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা নিয়ে পাঁচ বছর ধরেই আলোচনা চলছে। নতুন করে আলোচনাটি ওঠে কোভিড-১৯ চলাকালীন এ বছরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরকারি খাতের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ নেওয়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, ‘আমরা বিদেশ থেকে ডলারে ঋণ নিই। আমাদের যেহেতু ডলার আছে, সেহেতু নিজেদের ডলার থেকে নিজেরাই ঋণ নিতে পারি।’

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান পরে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান, ‘প্রধানমন্ত্রী একটি ধারণা দিয়েছেন। আলোচনা-পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ শেষে সিদ্ধান্তে আসা যাবে।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ একই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে চিঠি পাঠায়। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ বিভাগকে জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ অনুযায়ী কোনো প্রকল্পে রিজার্ভ ব্যবহারের সুযোগ নেই। তবে রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করা যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে সরকারকে নিশ্চয়তাদানকারী (গ্যারান্টার) হতে হবে এবং রিজার্ভ থেকে মার্কিন ডলারে কেউ অর্থ নিলে মার্কিন ডলারেই তা ফেরত দিতে হবে।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত রিজার্ভের অর্থ ব্যবহারের কৌশল ঠিক হয়নি। অথচ নীতিমালা জারি করার আগেই কেউ কেউ রিজার্ভ থেকে অর্থ চেয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকে আবেদন করে বসে আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রগুলো জানায়, যত আবেদনই আসুক না কেন, ব্যক্তি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠানকে রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ দেওয়া হবে না।

ভেস্তে গেছে আগের উদ্যোগ

রিজার্ভের অর্থের ব্যবহার নিয়ে ভিন্ন আকারে একটি প্রস্তাব অবশ্য প্রায় চার বছর আগেই অনুমোদন করেছিল মন্ত্রিসভা। ‘বাংলাদেশ সার্বভৌম সম্পদ তহবিল’ শীর্ষক একটি প্রস্তাবের খসড়া অনুমোদিত হয়েছিল ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায়। তখন বলা হয়েছিল, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থে ১ হাজার কোটি ডলারের তহবিল গঠন করবে সরকার।

অনুমোদনের পর তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ২০০ কোটি ডলার দিয়ে তহবিলটি শুরু হলেও পাঁচ বছরে এর আকার দাঁড়াবে ১ হাজার কোটি ডলার। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে এ তহবিলের অর্থ ব্যবহার করা যাবে।

তহবিলটি গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীকে প্রধান করে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি করেছিল সরকার। কমিটি একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিল।

একটি অর্থনীতিতে নির্ধারিত মেয়াদের দায় পরিশোধের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সঞ্চিত হতে থাকলে উদ্বৃত্ত রিজার্ভ বিশেষ উদ্দেশ্যে আলাদা করে যে বিনিয়োগ তহবিল গঠন করা হয়, সেটাই হচ্ছে সার্বভৌম সম্পদ তহবিল—ওই প্রতিবেদনে এ রকম একটি সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হওয়ার পরও বিষয়টি আর এগোয়নি।

আরও পড়ুন

বর্তমানে ৫০টির মতো দেশে রিজার্ভের অর্থে সার্বভৌম সম্পদ তহবিল রয়েছে বলে জানা গেছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হওয়ার পরও সার্বভৌম সম্পদ তহবিল কেন করা হলো না, জানি না। আর এবার সরকার কী করতে যাচ্ছে, তা–ও অজানা। নীতিমালা হওয়ার পর কথা বলা যাবে।

তবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, রিজার্ভের অর্থ ব্যবহারে কোনো অসুবিধা নেই। যারা নেবে, তারা ডলারেও ফেরত দিতে পারে, টাকায়ও ফেরত দিতে পারে। টাকায় ফেরত দিলেও সমস্যা নেই; কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক তো টাকা দিয়েই ডলার কেনে। তবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তা ব্যবহার করা না হলে মহা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ওই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।