সংকট উত্তরণে কোনো উদ্যোগ দেখি না

>করোনাভাইরাসের কারণে দেশের শিক্ষা খাতও এখন গভীর সংকটে, মান নিয়ে প্রশ্ন তো আগে থেকেই ছিল। অথচ নতুন বাজেটে শিক্ষা খাত নিয়ে আছে গতানুগতিক কিছু প্রস্তাব, কিছু বরাদ্দ বৃদ্ধি। সংকট উত্তরণে তা যথেষ্ট বলে মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা। তাহলে কী করতে হবে? সুনির্দিষ্ট কিছু পরামর্শ দিলেন ড. মনজুর আহমদ
মনজুর আহমদ
মনজুর আহমদ

শিক্ষা খাতে এবার যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, তা গতানুগতিক। এতে চিন্তা ও কল্পনার বিশেষ অভাব রয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষা খাতে সৃষ্ট সংকট উত্তরণের যথেষ্ট উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

দক্ষিণ এশিয়া ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে জাতীয় উৎপাদন ও জাতীয় বাজেটের অনুপাতে শিক্ষায় সর্বনিম্ন প্রাক্কলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট বাজেটের অন্তত ১‌৫ শতাংশ কেবল শিক্ষার জন্য বরাদ্দ রাখতে নাগরিক সমাজের দাবি মানা হয়নি। করোনা সংকটের ব্যাপক প্রভাবে শিক্ষায় আগে থেকে চলে আসা বৈষম্য ও দুর্বলতা আরও প্রকট হবে। ঝরে পড়ার হার, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ এবং দরিদ্র পরিবারের শিশুদের শিক্ষার সব দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া তীব্রতর হবে। শিক্ষক ও অভিভাবকেরাও এসব বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কিন্তু এসব বিষয়ে ভাবনার ছাপ প্রস্তাবিত বাজেটে নেই।

সংকট উত্তরণে উদ্ভাবনী কার্যক্রমের ভাবনা, প্রস্তাবনা এবং এসব বিষয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে দেনদরবারের দায় শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়)। এ জন্য শিক্ষায় নিবেদিত ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে সংলাপ আয়োজনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাজের অগ্রাধিকার বিবেচনা করা যেত। কিন্তু এই সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। শিক্ষার দায়িত্ব দুই মন্ত্রণালয়ে বিভক্ত থাকাও  হয়তো এ ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে।

করোনা সংকট কতকাল, কীভাবে চলবে এবং এর অভিঘাত কত গভীর হবে, তা এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত। এ থেকে উদ্ধার ও উত্তরণের জন্য প্রতিটি এলাকায় ও প্রতিটি বিদ্যালয়ে বেসরকারি সংস্থা, স্থানীয় সংস্থা এবং স্থানীয় সরকারকে সঙ্গে নিয়ে কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

প্রাক্‌–করোনার স্বাভাবিক অবস্থাতেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির অধিকাংশ শিশু শ্রেণির জন্য পাঠ্যক্রমে নির্ধারিত বাংলা ও অঙ্কের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। সরকারিভাবে পরিচালিত জাতীয় শিক্ষার্থী অর্জন যাচাই (ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট) জরিপ থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

করোনা সংকটের বহুমুখী প্রভাবে দক্ষতা অর্জন না করার সংখ্যা নিঃসন্দেহে অনেক বাড়বে। প্রাথমিক স্তরে বাংলা ও অঙ্কের ভিত্তি যে শিক্ষার্থীদের তৈরি হয় না, তারা স্থায়ীভাবে পিছিয়ে থাকে এবং ঝরে পড়াই হয় তাদের পরিণতি। রাজধানীতে অবস্থিত অধিদপ্তর থেকে আদেশ-নির্দেশ দিয়ে ভিত্তিমূলে দুর্বলতার সমাধান করা যাবে না। অভিজ্ঞতা থেকে তা-ই দেখা যাচ্ছে।

প্রতিটি বিদ্যালয়ে পিছিয়ে পড়া শিশুদের চিহ্নিত করে তাদের সহায়তা দিতে হবে, উৎসাহিত করতে হবে। অভিভাবকদেরও এই কাজে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই। বাড়তি কাজের জন্য স্থানীয় শিক্ষিত তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিতে হবে। তাঁদের এ জন্য প্রস্তুত করতে হবে। আর এসব কাজ বর্তমান প্রথাগত ধারায় চালালে সফল হওয়া যাবে না। সংকটকালে ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ প্রয়োজন। এই ধরনের উদ্যোগের জন্য এক সংলাপ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা (গড়ে প্রতি উপজেলায় ১৯ কোটি টাকা) বরাদ্দের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এ ধরনের আরও উদ্ভাবনী উদ্যোগের সুযোগ ও প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষায় বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযান এসব কার্যক্রমে সহায়ক হতে পারে।

প্রস্তাবিত বাজেটকে সাময়িক অনুমোদন দিয়ে ছয় মাস পর এটি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। জাতীয় সংসদ এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। করোনা পরিস্থিতি কবে, কীভাবে শেষ হয়, তা দেখার পর শিক্ষাসহ অনেক খাতেই নানা রকম পরিবর্তন আনা ও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন হবে।