সরকারের অদূরদর্শী নীতির ফল ভোগ করছে শ্রীলঙ্কা

ভবানী ফনসেকা

শ্রীলঙ্কার চলমান সংকট নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দেশটির বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভসের (সিপিএ) জ্যেষ্ঠ গবেষক ভবানী ফনসেকা। ই-মেইলে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো.শফিকুল ইসলাম।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: শ্রীলঙ্কায় কেন এ পরিস্থিতি তৈরি হলো? এর পেছনে মূল কারণ কী বলে মনে করেন?

ভবানী ফনসেকা: রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষের অনেক অব্যবস্থাপনা ও নীতিতে দুর্বলতা ছিল। রাসায়নিক সার ব্যবহারের ওপর আকস্মিক নিষেধাজ্ঞা ও কর কমানোর মতো বিপর্যয়কর কিছু নীতি নিয়েছেন তিনি। এ কারণে এ সংকট তৈরি হয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে জনগণের ওপর। ফলে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পরবর্তীকালে যা সহিংসতায় রূপ নেয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এ সংকটের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের দুর্নীতি কতটা ভূমিকা রেখেছে বলে আপনি মনে করেন?

ভবানী ফনসেকা: শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে। বিগত সরকারগুলো এ দুর্নীতি মোকাবিলা করতে ও অপরাধীদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৯ সালে গোতাবায়া রাজাপক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হলে অনেকে বিশ্বাস করেছিলেন, সরকার ও শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে। পেশাদারদের নিয়ে একটি টেকনোক্র্যাটিক সরকারের প্রতিশ্রুতি এ দেশের মানুষের মধ্যে আশা তৈরি করেছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন, শ্রীলঙ্কায় শাসনব্যবস্থার দুর্নীতি ও অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। কিন্তু তিন বছর পার না হতেই তাঁর ও আশপাশের লোকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নতুন অভিযোগ আসতে থাকে। এতে অনেকেই ক্ষুব্ধ ও হতাশ হন। অনেকেই এখন বিশ্বাস করেন, শ্রীলঙ্কায় বর্তমান অর্থনৈতিক পতনের পেছনে রাজাপক্ষে, তাঁর পরিবার ও আশপাশের মানুষের দুর্নীতি দায়ী।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদদের আগাম কোনো ধারণা ছিল কি? এ বিষয়ে সরকারকে কেউ কোনো পরামর্শ কি দিয়েছিল?

ভবানী ফনসেকা: বেশ কিছু বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এসব সতর্কতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি রাজাপক্ষে ও তৎকালীন সরকার অদূরদর্শী নীতি অব্যাহত রেখেছিল। এখন শ্রীলঙ্কার জনগণ তার ফল ভোগ করছে।

বন্ধ পাম্পের সামনে পেট্রল কিনতে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীলঙ্কানরা। কলম্বো, শ্রীলঙ্কা। ১৬ মে, ২০২২
ছবি: রয়টার্স

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এ অবস্থার জন্য আপনি রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা কতটা দায়ী বলে মনে করেন? প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে কি?

ভবানী ফনসেকা: শ্রীলঙ্কায় সরকার ও শাসনব্যবস্থার সম্পূর্ণ ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত কয়েক বছরে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিকীকরণ ও সরকারের কর্তৃত্ববাদ বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। ২০২০ সালে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতা বাড়ালে তা রাষ্ট্রের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ও সংসদকে দুর্বল করে দেয়। পাশাপাশি করোনার মধ্যে গত দুই বছরে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা তাদের কাঠামোগত দুর্বলতাকে আরও উন্মোচিত করেছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট এখন রাজনৈতিক সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। ঋণে জর্জরিত এ জাতির মুক্তির উপায় কী?

ভবানী ফনসেকা: বর্তমান সংকট মোকাবিলায় শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় দিকেই স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। তার আগে প্রয়োজন স্থিতিশীল একটি সরকার। ৯ মে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগের পর শ্রীলঙ্কায় তিন দিন প্রধানমন্ত্রী বা সরকার ছিল না। ফলে একটি বিপজ্জনক রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দেয়। ১২ মে রনিল বিক্রমাসিংহে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসে। তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিক্রমাসিংহের নিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কারণ, অনেকেই ইতিমধ্যে এ পদে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাই নতুন সরকারের অধীন আগামী দিনগুলোতে শ্রীলঙ্কায় স্থিতিশীলতা আসবে কি না, তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের অবস্থা কেমন হবে?

ভবানী ফনসেকা: দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়িয়েছে। কলম্বোয় নতুন প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বৈঠকটি ছিল ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে। এটি ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই প্রমাণ করে। পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থসহায়তাও শ্রীলঙ্কার জন্য বিশেষ উপকার করেছে চলমান সংকটে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: শ্রীলঙ্কার সংকট নিয়ে চীন এখনো নীরব। ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কেমন হবে বলে মনে করেন?

ভবানী ফনসেকা: শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চীনের সম্পর্কের একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তবে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের অধীন ও পরবর্তীকালে ২০১৯ থেকে গোতাবায়া রাজাপক্ষের সময়ে চীনের দিকে ঝোঁক ছিল শ্রীলঙ্কার। এ সময়ে হামবানটোটা বন্দর, মাত্তালা বিমানবন্দর ও মহাসড়কের মতো অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য শ্রীলঙ্কা চীনের কাছ থেকে ব্যাপক ঋণ পেয়েছে। তবে এগুলো শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার জন্য ঋণের ফাঁদে পরিণত হয়। এখন দেখার বিষয়, নতুন প্রধানমন্ত্রী ও সরকার কীভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। তবে খুব সম্ভবত বর্তমান সংকট কাটাতে শ্রীলঙ্কাকে একক কারও ওপর নির্ভর না করে যারাই দেশটিকে সহায়তা দিতে পারবে, তাদের কাছে সহায়তা চাইতে হবে।