স্কুল বন্ধে ক্ষতি ১০ লাখ কোটি ডলার

সম্প্রতি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল অব ম্যানেজমেন্টে বক্তৃতা দেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংকের চারটি কর্মযজ্ঞের দিকে আলোকপাত করেন তিনি। তিনি সতর্ক করে বলেন,

  • এই মহামারি বিশ্বের প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষকে আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দেবে।

  • শিশুরা স্কুলে যেতে না পারায় ১০ লাখ কোটি ডলারের উপার্জন থেকে বঞ্চিত হতে পারে বিশ্ব

  • নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে, শিশু মৃত্যুহার ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

মালপাসের সেই বক্তব্যের এমনই কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো। অনুলেখন করেছেন প্রতীক বর্ধন

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস
ছবি: রয়টার্স

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করছে। একদিকে যেমন মানুষের জীবন রক্ষা, তেমনি অন্যদিকে দরিদ্র ও অরক্ষিত মানুষকে রক্ষা, ব্যবসার টেকসই উন্নয়ন ও উন্নত উপায়ে পুনর্নির্মাণ এ সবকিছুর সমন্বয় করেছে বিশ্বব্যাংক। আজ আমি বিশ্বব্যাংকের এই কর্মযজ্ঞের চারটি দিক নিয়ে আলোকপাত করব। এগুলো হলো—     দারিদ্র্য ও অসমতা দূরীকরণে দ্বিগুণ প্রচেষ্টা, মানব পুঁজির ধ্বংসসাধন, গরিব দেশগুলোকে রক্ষা করা এবং তাদের ঋণ পরিশোধ প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা আনা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, ২০২১ সালের মধ্যে আরও প্রায় ১১ থেকে ১৫ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের কবলে পড়বে।
ছবি: রয়টার্স

১. দারিদ্র্য ও অসমতা

চরম দারিদ্র্য দূরীকরণে পৃথিবী যে অগ্রগতি অর্জন করেছিল, কোভিড-১৯ তাতে এক অভূতপূর্ব ধাক্কা দিয়েছে। গড় মাথাপিছু আয়ের গড় মান ও অভিন্ন সমৃদ্ধি অর্জনের পথে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মহামারি। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, ২০২১ সালের মধ্যে আরও প্রায় ১১ থেকে ১৫ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের কবলে পড়বে। অর্থাৎ এই মহামারি বিশ্বের প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষকে আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দেবে।

২০০৮ সালের আর্থিক সংকট ঠিক এবারকার মতো ছিল না, সেবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মূলত আর্থিক বাজার, আর ধাক্কাটা খেয়েছিল মূলত উন্নত দেশগুলো। উন্নয়নশীল দেশগুলো সেবার অতটা আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু এবারের সংকট অনেক গভীর-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, সম্পদশালী মানুষেরা যতটা না আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন সম্পদহীন মানুষেরা।
ছবি: রয়টার্স

সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, সম্পদশালী মানুষেরা যতটা না আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন সম্পদহীন মানুষেরা। গড় আয় হ্রাস ও ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য আরেক মহামারির রূপ নিয়েছে-আমাদের সেটা উল্টে দিতে হবে-দরকার এর অবসান।
গরিব দেশগুলো সামষ্টিক অর্থনীতির দিক থেকে অতটা শক্তিশালী নয়। স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সেখানে বেশি কঠিন। সেই সঙ্গে দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামোর কারণে মানুষের দুর্দশার কোনো শেষ নেই। তাদের পক্ষে রাতারাতি অবস্থা পাল্টানো সম্ভব নয়।

কোভিডের কারণে এই সব দেশের রেমিট্যান্স প্রাপ্তিও অনেক কমে যাচ্ছে, যেসব দেশ পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল, তারা পড়েছে বিপদে। পৃথিবী এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সংযুক্ত-সবাই সবার খবর রাখে। তাতে এই পরিস্থিতিতে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যেমন কষ্টকর হবে, তেমনি গণতন্ত্র রক্ষা করাও কঠিন। ফলে সবাই উপকৃত হতে পারে-এ রকম ধাঁচের টেকসই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া দরকার।

২. মানব পুঁজি

কোভিড-১৯-এর আগে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানব পুঁজির উল্লেখযোগ্য বিকাশ হচ্ছিল। এমনকি নারী-পুরুষ বিভাজনও কমে আসছিল। কথা হলো, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে মানব পুঁজি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। জ্ঞান, দক্ষতা, স্বাস্থ্যমান এগুলোই হলো মানব পুঁজির মূল উপাদান-এক জীবনে মানুষ এসব যতটা অর্জন করতে পারে, সেটাই তাঁর পুঁজি। ব্যক্তি মানুষ ও রাষ্ট্রের মানব পুঁজি অর্জনে উচ্চ আয় প্রয়োজন, আর দরকার হচ্ছে, শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন।

মহামারির শুরু থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ১৬০ কোটি শিশু বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না।
ছবি: রয়টার্স

মহামারির শুরু থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ১৬০ কোটি শিশু বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। একটু ঘুরিয়ে বলা যায় বিষয়টি। তা হলো এই শিশুরা জীবদ্দশায় ১০ লাখ কোটি ডলারের উপার্জন থেকে বঞ্চিত হতে পারে। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়ছে। আর স্বাস্থ্য সেবার ঘাটতি ও খাদ্য স্বল্পতার কারণে শিশু মৃত্যুহার ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

নানা কারণে অনেক দেশে ঋণের বোঝা বেড়েছে, যেখানে ভুল করা সুযোগ নেই বললেই চলে। বৈশ্বিক ঋণ বাজার থেকে দেশগুলো কম সুদে ঋণ নিতে পারে। এতে অনেক দেশ বেশি বেশি ঋণ নিয়ে ফেলে। কিন্তু এই ব্যবস্থায় এমন কিছু শর্ত থাকে যার কারণে ঋণগ্রহীতা দেশ ও জনগণের চেয়ে ঋণদাতারা তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস

শিক্ষায় এই মহামারির প্রভাব হ্রাস করতে আমরা বিভিন্ন দেশকে বিদ্যালয় পুনরায় খোলার ক্ষেত্রে সহায়তা করছি। দরিদ্র দেশগুলোর জন্য এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ও সব দেশে বিদ্যালয়ে গেলেই দরিদ্র শিশুরা খাবার ও নিরাপত্তা পায়। এ ছাড়া ৬৫টি দেশের সঙ্গে আমরা দূরশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছি। ইউনিসেফ ও ইউনেসকোর সঙ্গে আমরা বিদ্যালয় পুনরায় চালুর কাঠামো নিয়ে কাজ করছি।

৩. ঋণের বোঝা

নানা কারণে অনেক দেশে ঋণের বোঝা বেড়েছে, যেখানে ভুল করা সুযোগ নেই বললেই চলে। বৈশ্বিক ঋণ বাজার থেকে দেশগুলো কম সুদে ঋণ নিতে পারে। এতে অনেক দেশ বেশি বেশি ঋণ নিয়ে ফেলে। কিন্তু এই ব্যবস্থায় এমন কিছু শর্ত থাকে যার কারণে ঋণগ্রহীতা দেশ ও জনগণের চেয়ে ঋণদাতারা তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। কিন্তু সার্বভৌম দেউলিয়া বিধি নেই, যাতে ঋণগ্রহীতার আংশিক ঋণ পরিশোধ করতে পারে বা ঋণদাতাদের দাবি কমতে পারে। ফলে ঋণদাতারা যত দিন চাইবে, তত দিন ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য।

এই পরিস্থিতিতে আইএমএফের ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা ও আমি মার্চ মাসে এই দরিদ্র দেশগুলোর ঋণ পরিশোধ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এরপর জি ২০, জি৭, প্যারিস ক্লাব ও ডেবট সার্ভিস সাসপেনশন ইনিশিয়েটিভের সম্মতিতে তা ১ মে থেকে কার্যকর হয়। অক্টোবরের ১২ তারিখে আমরা সার্বভৌম ঋণের ব্যাপারে বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করব। সেখানে আরও দিক নির্দেশনা থাকবে।

৪. অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিস্থাপক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া

কিছু কিছু দুর্যোগে জাতীয় সীমান্ত বিশেষ সমাধান দেয় না,Ñকোভিড-১৯-এর মতো মহামারি আমাদের সেই শিক্ষা দেয়। এর আগে থেকেই পরিবেশ বিপর্যয় আমাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। সে জন্য টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি চলছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নয়ন দরকার। সেটা করতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে মালিকানার ধরন পাল্টানো এবং ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ব্যবহারের লক্ষ্য পরিবর্তন। সম্ভবত, দেউলিয়া বিধি সংক্রান্ত প্রক্রিয়া দ্রুততর করা, ছোট দাবির জন্য আইনি প্রক্রিয়া প্রণয়ন ও সালিস চালু করা। কিন্তু খুব বেশি উন্নয়নশীল দেশে এসব নেই।

আমার মত হচ্ছে, টেকসই সমাধানের জন্য পরিবর্তন মেনে নিতে হবে-দরকার হচ্ছে উদ্ভাবন, বিদ্যমান সম্পদেও নতুন ব্যবহার, কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন, ঋণ পুনর্গঠন ও সুশাসন ব্যবস্থা।