১৬ বছরের ব্যর্থতার চক্করে চামড়াশিল্প

২০০ একর জমিতে একটি চামড়াশিল্প নগর করতে ১৬ বছর পার করেছে সরকার। প্রকল্প নেওয়া হয় ২০০৩ সালে। এখনো কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। কঠিন বর্জ্য ফেলার জায়গা বা ডাম্পিং ইয়ার্ডের কাজ শুরুই হয়নি। জমির দাম ঠিক হয়েছে মাত্র তিন মাস আগে। কোনো ট্যানারিমালিক ইজারা দলিলও বুঝে পাননি।

চামড়াশিল্পে রপ্তানি আয় কমে যাওয়া এবং কাঁচা চামড়ার দামে ধস এই ব্যর্থতারই মাশুল। চামড়াপণ্য উৎপাদনকারী, ট্যানারিমালিক ও আড়তমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন বছর ধরেই দেশে চামড়ার দাম কম। এ বছর যা তলানিতে ঠেকেছে। রেওয়াজ অনুযায়ী, প্রতিবছর ঈদুল আজহায় ট্যানারিমালিকেরা আড়তমালিকদের পুরোনো বকেয়া শোধ করেন, যা দিয়ে চামড়া কিনে আবার ট্যানারিমালিকদের দেন আড়তদারেরা।

ট্যানারিমালিকেরা বলছেন, রপ্তানি আয় কমে যাওয়া এবং ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত ঋণ না পাওয়ায় এবার তাঁরা চামড়া কিনতে আড়তমালিক ও ফড়িয়াদের টাকা দিতে পারেননি।

রপ্তানি আয় কমে যাওয়াসহ ব্যাংকঋণ না পাওয়ার সঙ্গে অবশ্য চামড়াশিল্প নগর প্রস্তুত না হওয়া এবং জমির ইজারা দলিল বুঝে না পাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে।

দাম না পেয়ে দেশের মানুষ চামড়া ফেলে দিচ্ছে। বিপরীতে দেশে ২০১৮–১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে প্রায় ৯৪৫ কোটি টাকার বিদেশি চামড়া। কেন এই আমদানি? কারণ, চামড়াশিল্প নগর পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় বিদেশি বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশি চামড়ার তৈরি পণ্য কেনে না। এ কারণে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের মতো বড় প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে চামড়া এনে তা দিয়ে পণ্য তৈরি করে রপ্তানি করে।

এবার চামড়ার দামে ধসের সঙ্গে শিল্পনগরের কাজ শেষ না হওয়ার যোগ কী, জানতে চাইলে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মোমেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘চামড়াশিল্প নগর যদি পরিবেশবান্ধব হতো, তাহলে আমরা দেশি চামড়ার পণ্য ইউরোপ–আমেরিকায় রপ্তানি করতে পারতাম। আমাদের কারখানায়ও দেশি চামড়া ব্যবহার করতে পারতাম। সেটা পারছি না।’ তিনি জানান, তিন বছর আগেও বড় কারখানাগুলো দেশি চামড়ায় তৈরি পণ্য ইউরোপে রপ্তানি করত। কিন্তু একটি বিদেশি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) পরিবেশদূষণের অভিযোগ করে ক্রেতাদের চিঠি লেখে। এতে দেশি চামড়ার ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।

পরিবেশদূষণের অভিযোগের মধ্যেই চামড়ার রপ্তানি আয় বাড়ছিল। হঠাৎ করে গত কয়েক বছরে কেন কমছে, তার ব্যাখ্যাও দেন মোমেন ভূঁইয়া। বলেন, বাংলাদেশি চামড়ার মূল ক্রেতা চীন। চীনাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্ক আরোপের কারণে দেশটিতে চামড়ার চাহিদা কমেছে। এ কারণে তারা বাংলাদেশি চামড়া নেওয়া কমিয়েছে। তিনি মনে করেন, এখন শিল্পনগর প্রস্তুত থাকলে ইউরোপ ও আমেরিকায় সরাসরি চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা যেত। কিন্তু সেই সুযোগ নেওয়া যাচ্ছে না। 

রপ্তানিতে ধস
চামড়া দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি আয়ের খাত। ২০২১ সাল নাগাদ এ খাতে ৫০০ কোটি ডলার আয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু চামড়া রপ্তানি কমছে। ২০১৮–১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১০২ কোটি ডলার আয় করে, যা আগের বছরের চেয়ে ৬ শতাংশ কম। ২০১৬–১৭ অর্থবছরে চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ছিল ১২৩ কোটি ডলারের বেশি।

ট্যানারিমালিকেরা জানান, ২০১৭ সালের এপ্রিলে হঠাৎ হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর সাভারে উৎপাদনে যেতে অনেক সময় লেগে যায়। অনেক ট্যানারি এখনো উৎপাদনে যেতে পারেনি। এ কারণে ভারত ও জাপানের অনেক ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে চলে গেছে। 

মাইজদী ট্যানারির পরিচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘এখন চীনারাই আমাদের একমাত্র ক্রেতা। তারাও সুযোগ নিয়ে দাম এত কম বলছে যে তাতে উৎপাদন খরচও ওঠে না। রপ্তানি না হওয়ায় কারখানায় চামড়ার স্তূপ জমে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত ঈদুল আজহার পর আমি ৪৫ হাজার চামড়া কিনেছিলাম, যার অর্ধেক এখনো রয়ে গেছে।’ 

শিল্পনগরের চিত্র
১৯৫১ সালের ৩ অক্টোবর এক গেজেটের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণ করে সরকার নারায়ণগঞ্জ থেকে চামড়াশিল্পকে হাজারীবাগে আনে। কিন্তু পরে সেখানে বর্জ্য শোধনের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নালা দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়ত। রাস্তার পাশে, ডোবায় ফেলা হতো কঠিন বর্জ্য। 

পরিবেশদূষণ রোধে ২০০৩ সাভারে চামড়াশিল্প নগর প্রকল্প নেওয়া হয়। ব্যয় ধরা হয় ১৭৬ কোটি টাকা। পরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারসহ নানা খাতে ব্যয় ধরে মোট প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। বর্জ্য পরিশোধনাগার নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১২ সালের ১১ মার্চ। ট্যানারিমালিকদের হাজারীবাগ থেকে সাভারে নেওয়ার কাজটি সরকার করতে পারেনি, হয়েছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে। 

চামড়াশিল্প নগরে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৫৪টি ট্যানারিকে। এর মধ্যে ১২৪টি কার্যক্রম শুরু করেছে। সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগর গতকাল ঘুরে দেখা যায়, সিইটিপির ক্রোম রিকভারি ইউনিট চালু হয়নি। কঠিন বর্জ্য সিইটিপির পাশের পুকুরে ফেলা হচ্ছে। ফলে আগের মতোই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। অন্যদিকে ড্রেনের সংস্কারকাজ শেষ না হওয়ায় ট্যানারিগুলো পুরোদমে উৎপাদন শুরু করলে আশপাশের সড়ক বর্জ্যে সয়লাব হওয়ার আশঙ্কা আছে। গত এক বছরে চামড়াশিল্প নগরের বড় উন্নতি বলতে সড়কের উন্নতি।

জমির জটিলতায় পুঁজি সংকট?
দীর্ঘ সময় ধরে উদ্যোক্তারা জমির মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়ার দাবি করলেও সরকার দাম ঠিক করতেই বহু বছর লাগিয়েছে। অবশেষে গত মে মাসে প্রতি বর্গফুট জমির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৭১ টাকা। 

এদিকে ট্যানারি নির্মাণ করে উৎপাদন শুরু করলেও কোনো উদ্যোক্তাই জমি ইজারার দলিল পাননি। কয়েকজন ট্যানারিমালিক আক্ষেপ করে বলেন, কারখানা ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে তাঁদের পুঁজি শেষ। জমি ইজারার দলিল না পাওয়ায় তাঁরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেননি। সে জন্য তাঁরা আড়তদারদের বকেয়া পরিশোধ করতে পারছেন না। 

ইকবাল ব্রাদার্স ট্যানারির স্বত্বাধিকারী মো. শামসুদ্দিন বলেন, ‘চার কোটি টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করেছি। আমি জমির মূল্যের সব কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করেছি। কিন্তু ইজারা দলিল দিচ্ছে না বিসিক। সে জন্য ব্যাংক থেকেও ঋণ নিতে পারছি না। ফলে কারখানার খরচ মেটাতে কম দামে চীনা ক্রেতাদের কাছে লোকসানে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।’ 

দায় আছে, বললেন বিসিক চেয়ারম্যান
চামড়াশিল্প নগর নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত হয়েছে গত ছয় মাসে। এ সময়েই জমির দাম ঠিক করার পাশাপাশি সিইটিপি পরিচালনার জন্য কোম্পানি গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, চামড়াশিল্প নগর নিয়ে গত ছয় মাসে যে অগ্রগতি হয়েছে, সেটা আগে হলে আজকের দুর্দশা হতো না। 

১৬ বছরে চামড়াশিল্প নগরের কাজ শেষ করতে না পারার জন্য বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) দায় আছে কি না, জানতে চাইলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. মোশতাক হাসান বলেন, অবশ্যই বিসিকের দায় ছিল। বিসিকসহ অনেকের গাফিলতি ছিল। ২০০৩ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও জমি অধিগ্রহণে অনেক সময় লাগে। 

বিসিক চেয়ারম্যান বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সিইটিপি পুরোদমে চালু হবে। ট্যানারিমালিকেরা সার্ভিস চার্জসহ জমির দাম পরিশোধ করলেই দলিল দেওয়া হবে।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক আবু ইউসুফ বলেন, চামড়াশিল্প নগর নিয়ে দূরদর্শিতার অভাব ছিল। বিসিকের মতো ক্ষুদ্র একটি সংস্থার হয়তো বড় শিল্পনগর করার সক্ষমতা নেই। আবার সিইটিপি নির্মাণের ক্ষেত্রেও ভবিষ্যৎ ভাবা হয়নি। এটির সক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার। কিন্তু পুরোদমে উৎপাদন চলার সময় ৩৮ হাজার ঘনমিটার পর্যন্ত বর্জ্য তৈরি হয়।