৩২ কোটি টাকা জলে গেল

আসন্ন জনশুমারির আগে খানাপ্রধানের তালিকা তৈরির পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়েছে। তার আগেই খরচ হয়ে গেছে ৩২ কোটি টাকা।

দেশে জনসংখ্যা কত, তা জানতে ঐতিহ্যগতভাবে প্রতি ১০ বছর পর ঘরে ঘরে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ২০১১ সালের পর এ বছরও জনশুমারি ও গৃহগণনা হবে। চলতি জানুয়ারিতে জনশুমারি শুরু করার কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে তা পিছিয়ে আগামী অক্টোবরে নেওয়া হয়েছে।

এবারে জনশুমারি শুরুর আগে খানাপ্রধানের তালিকা করা হবে কি না, সেটি নিয়ে কিছুদিন বিবিএসে তুলকালাম চলে। শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে এই কাজের জন্য ৩২ কোটি টাকার উপকরণ কেনা হয়ে গেছে। এখন এসব উপকরণ অচল। কারণ, উপকরণগুলো জনশুমারির অন্য কোথাও ব্যবহারের সুযোগ নেই। এখন এসব উপকরণ বিক্রি করে দেওয়া কিংবা পুড়ে ফেলা অথবা ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে আবার প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও বাড়তি খরচের হ্যাপা আছে। অর্থাৎ ৩২ কোটি টাকাই অপচয় হচ্ছে। তবে এর মধ্যেও বিবিএসের কিছু কর্মকর্তা এভাবে সান্ত্বনা খুঁজছেন, ৩২ কোটি টাকা অপচয় হলেও খানাপ্রধানের তালিকা বা লিস্টিং করার জন্য বরাদ্দ রাখা ৩৫৫ কোটি টাকা তো সাশ্রয় হচ্ছে!

বিবিএস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যার হালনাগাদ তথ্য জানার জন্য ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা’ নামে ১ হাজার ৭৬২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। প্রকল্পটিতে বলা ছিল, মূল শুমারি শুরুর আগে দেশের চার কোটি খানায় গিয়ে প্রত্যেক খানাপ্রধানের তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তথ্য সংগ্রহ শেষ করে খানাপ্রধানকে একটি প্লাস্টিকের কার্ড দেওয়া হবে। মূল শুমারিতে আবার চার কোটি খানায় গিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হবে। মোট তিনবার একটি খানায় যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল অনুমোদিত প্রকল্পে।

বিবিএসের নথিপত্রে দেখা যায়, চার কোটি খানাপ্রধানের তথ্য সংগ্রহের জন্য লিস্টিং বা তালিকাভুক্তি ফরম ছাপানো হয়েছিল। এই ফরম কীভাবে ব্যবহার করা হবে, সে জন্যও ছাপানো হয় লিস্টিং ম্যানুয়াল। এ জন্য খরচ হয়েছে ১০ কোটি টাকা। খানাপ্রধানের তালিকা তৈরির ফরম পূরণ করার জন্য ১১ কোটি টাকার কলম, প্রচারণার জন্য ৭ কোটি টাকার স্টিকার কেনা এবং ৪ কোটি টাকার নোটবুক কেনা হয়েছে। সব মিলিয়ে খানাপ্রধানের তালিকা করা বাবদ এক বছর আগেই ৩২ কোটি টাকা খরচ করা হয়ে গেছে। এসব লিস্টিং ফরম ও ম্যানুয়াল, স্টিকার, কলম, নোটবুক সব জেলায় পাঠানো হয়েছিল। এখন আবার সব ফিরিয়ে আনা হচ্ছে ঢাকায় বিবিএসের সদর দপ্তরে।

এদিকে শুমারি শুরুর আগেই এত উপকরণ কেনাকাটা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি বলেন, জনশুমারি প্রকল্পটি অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক উপকরণ কেনাকাটা করা হয়েছে। এসব উপকরণ এত আগে কেনা উচিত হয়নি। কারণ, সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট বয়স আছে। এখন ওই সব উপকরণ নষ্ট হবে।

সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, যেকোনো উপকরণ সঠিক সময়ে কেনাই জরুরি। আগেও করা যাবে না, আবার অনেক পরেও নয়। যথাসময়ে কেনাকাটা করতে হবে। জনগণের টাকা খরচে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি নিজেও আমলাতন্ত্রে ছিলাম। তখন দেখেছি, পাবলিকেশন ও প্রিন্টিংয়ের কিছু কিছু খরচ আমার কাছে অপচয় মনে হয়। তাই যেসব কর্মকর্তা কেনাকাটার সঙ্গে থাকবেন, তাঁদের সাবধানে থাকতে হবে।’

বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত যে পাঁচটি জনশুমারি হয়েছে, এর কোনোটিতে কোথাও মূল শুমারি শুরুর আগে খানাপ্রধানের তথ্য সংগ্রহের অংশ ছিল না। এবারেই শুধু তা রাখা হয়েছিল, যদিও খানাপ্রধানের যে তথ্য আনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা মূল শুমারিতেও করা হবে। তাই একই তথ্যের জন্য একটি খানায় তিনবার যাওয়ার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন বিবিএসের অনেক কর্মকর্তা।

কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই মানুষ এক জেলা থেকে আরেক জেলায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। বিশেষ করে একটা বড় অংশ অহরহ রাজধানীতে আসছে। ফলে আগেভাগেই যদি খানাপ্রধানের তথ্য আনা হয়, তাহলে মূল শুমারির সময় সেখানে গিয়ে ওই পরিবারকে না পাওয়ার আশঙ্কা থাকবে বেশি। সম্প্রতি এক আন্তমন্ত্রণালয় সভায়ও জানানো হয়, খানাপ্রধানের তালিকা করার জন্য যে ফরম ছাপানো হয়েছিল, সেটার নকশা ছিল পুরোপুরি ভুল। ২৪ ডিজিটের কোডের ওই ফরমে একটু হেরফের হলে পুরো তথ্যই পরিবর্তনের আশঙ্কা রয়েছে। এসব বিবেচনা থেকেই খানাপ্রধানের তালিকা তৈরির পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়েছে।

ওই সভায় একাধিক কর্মকর্তা জানান, লিস্টিংয়ের নামে বরাদ্দ রাখা ৩৫৫ কোটি টাকায় ব্যাপক অনিয়মের সুযোগ ছিল। সব মিলিয়ে জনশুমারি থেকে খানাপ্রধানের তালিকা বাদ দেওয়ার বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী সায় দেন।

জানতে চাইলে বিবিএসের মহাপরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘অনুমোদিত প্রকল্পে খানাপ্রধানের লিস্টিং বা তালিকার পরিকল্পনা থাকলেও সময়ের প্রয়োজনে, বাস্তবতার কারণে আমরা সেটি বাদ দিয়েছি। আমরা একসঙ্গে অক্টোবরেই মূল শুমারি করব। তার আগে লিস্টিং করব না। লিস্টিংয়ের জন্য যে টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল, এখন তা সাশ্রয় হবে।’