মানুষ এখন ব্যাংক খাত নিয়ে চিন্তিত, সিপিডির সংলাপে বক্তারা

ব্যাংকপ্রতীকী ছবি

দেশের সাধারণ মানুষ এখন ব্যাংক খাত নিয়ে খুবই চিন্তিত। ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ী ও ব্যাংক মালিকেরা মিলে নিচ্ছেন। তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ডলারের দামসহ নানা সিদ্ধান্ত নিয়েও তা যথাযথাভাবে কার্যকর করতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংক খাতের ওপর জনগণের আস্থা কমছে।  কারণ, ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্যের ক্রমাগত অবনতি হলেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বিক্ষিপ্তভাবে সংস্কার না করে কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। এ জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সামনে কী’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা এ মতামত দিয়েছেন। সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। সঞ্চালনা করেন সংস্থাটির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর লেকশোর হোটেলে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।

মূল প্রবন্ধে ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে স্বজনতোষী পুঁজিবাদের মাধ্যমে অভিজাত ব্যক্তিরা তাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

সংলাপে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ১০ বছর ধরে ব্যাংক খাতের খারাপ অবস্থার কথা বলা হচ্ছে। হঠাৎ একদিন সকালে উঠে শুনলাম, ১০টি ব্যাংক একীভূত করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এত দিন কী করছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। বেসিক ব্যাংক নিয়ে কত দিন ধরে কথা হচ্ছে। এসবের দায়িত্ব কেন জনগণ নেবে। এখন সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি (এএমসি) নিয়ে কথা হচ্ছে। কেন জনগণের করের টাকা সেখানে দেওয়া হবে। এএমসি হবে একটা কৃষ্ণগহ্বর, যা পুরো ব্যাংক খাতকে ধ্বংস করে দেবে।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক হঠাৎ বলে দিল কোন ব্যাংক কার সঙ্গে একীভূত হবে। কিসের ভিত্তিতে এটা বলা হচ্ছে। যারা চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা করে লুট করল, তাদের কী হবে সেটা কেন বলা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ডলারের দাম ৮৪ টাকায় ধরে রাখা হলো। সেটা এখন বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু আমদানি করতে গেলে ১২০ টাকার নিচে ডলার মিলছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক একটা অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ জন্য আজ ব্যাংক খাতের এই পরিস্থিতি।

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ব্যাংক খাতকে ঠিক করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। অর্থনীতি বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য থাকা দরকার। এর মধ্যে রাজনীতি খোঁজা উচিত না। গ্রামের সাধারণ মানুষ ব্যাংক খাত নিয়ে চিন্তিত। এ জন্য সবকিছুর মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন না করে, শিষ্টের দমন ও দুষ্টের পালন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যবসায়ী ও ব্যাংক পরিচালকেরা মিলে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক, সমবায় প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সকালে এক রকম নিয়ম করে, বিকেলে আবার আরেকজনের কথা শুনে তা পরিবর্তন করে। বর্তমানে মাত্র ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়েই ঋণ পুনঃ তফসিলে করা যাচ্ছে। আমার সময় প্রথমবার পুনঃ তফসিলে ১০ শতাংশ, দ্বিতীয়বারে ২০ শতাংশ ও তৃতীয় বার পুনঃ তফসিলে ৩০ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হতো। তাই লোকজন ভয়ে তখন এ পরিস্থিতিতে যেত না। এখন সবাই মহাআনন্দে এ পথে পা বাড়াচ্ছে।

সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও ব্যাংক খাত তদারকি একই প্রতিষ্ঠান করবে নাকি পৃথক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। যে ৪ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ হয়েছে, তার ৩০-৪০ শতাংশ জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া।

অন্যান্য প্রসঙ্গ

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকে অনেক শেয়ারহোল্ডার থাকলেও নিয়ন্ত্রণ করে একজনই। একজনের প্রভাবের কারণে ব্যাংকগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, অলিগার্করা (ধনী প্রভাবশালী গোষ্ঠী) এখন সব জায়গা নিয়ন্ত্রণ করছে। পুরো ব্যাংক খাত ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে গেছে।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ব্যাংকিং খাত সংক্রামক রোগে আক্রান্ত। ব্যবসায়ী, ব্যাংক ও সরকারের প্রভাবশালীরা মিলে জোট করেছেন। এসব বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা না করলে প্রকৃত সমাধান হবে না। ফারমার্স ব্যাংক ‘নাই’ হয়ে গেল, পদ্মা করেও টিকল না। বেসিক ব্যাংক চেয়ারম্যানকে ধরা হয় না। পি কে হালদার দেশে না, পাশের দেশে ধরা পড়ে। এর মাধ্যমে অপশাসন চর্চা করা হচ্ছে কি না, এ প্রশ্ন রাখেন তিনি।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, এক ব্যক্তির হাতে অনেকগুলো ব্যাংক। তাতে তার হাতে ব্যাংক খাত জিম্মি হয়ে পড়েছে, এটা কারও অজানা নয়। বেসরকারি ব্যাংকে জমিদারি প্রথা চালু হয়েছে। ব্যাংকের কারণে আর্থিক খাতের ওপর আস্থা শূন্যের কোটায় চলে গেছে। ১-২ টি ব্যাংক এখন ভালো আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন আছে এটা বোঝাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করা হোক। ক্ষমতা কাঠামো থেকে দুষ্ট লোকদের প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করা হোক। এ ছাড়া তথ্য লুকানোর সংস্কৃতি বন্ধ করা হলে ব্যাংক খাত ঠিক হয়ে যাবে।