দেশের ব্যবসার পরিবেশে তেমন উন্নতি হয়নি: বিবিএক্স জরিপ

২০২৪–২৫ অর্থবছরের ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে ব্যবসা পরিবেশ সূচক প্রকাশ করেছে মেট্রো চেম্বার ও পলিসি এক্সচেঞ্জ। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রতিবেদন হাতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনসহ অন্য অতিথিরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর পুলিশ প্লাজায় মেট্রো চেম্বার মিলনায়তনে।

বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশে বলার মতো কোনো উন্নতি হয়নি। উল্টো গত এক বছরে আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামোসুবিধা, শ্রম নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য সহজীকরণ, প্রযুক্তি গ্রহণ এবং পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ ও মান—এই ছয় সূচকে পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। তবে ব্যবসা শুরু, জমি প্রাপ্তি, বিরোধ নিষ্পত্তি, কর পরিশোধ ও ঋণের প্রাপ্যতা সূচকে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ব্যবসা পরিবেশ সূচক বা ক্লাইমেট ইনডেক্সে (বিবিএক্স) এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এবার দেশের ব্যবসা পরিবেশ সূচকে অর্জিত পয়েন্ট ৫৯ দশমিক ৬৯। তার মানে হচ্ছে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিবেশ চ্যালেঞ্জিং। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অর্জিত পয়েন্ট ছিল ৫৮ দশমিক ৭৫। সেই হিসাবে গত এক বছরে ব্যবসা পরিবেশ সূচকের মান শূন্য দশমিক ৯৪ পয়েন্ট বাড়লেও চ্যালেঞ্জিং অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেনি।

বিবিএক্সের প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ, ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধি ও বিনিময় হারের অস্থিরতার কারণে বিদায়ী অর্থবছরে ব্যবসার পরিবেশ চ্যালেঞ্জিং অবস্থায় রয়েছে। যদিও গত বছরের আগস্টে ছাত্র আন্দোলন ও গণ–অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। তারপর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

চতুর্থবারের মতো বিবিএক্স জরিপ করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ। রাজধানীর গুলশানে এমসিসিআইয়ের কার্যালয়ে আজ বৃহস্পতিবার আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

অনুষ্ঠানে বিবিএক্স প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এমসিসিআইয়ের সভাপতি কামরান টি রহমান।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের এমডি রূপালী চৌধুরী, জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) বাংলাদেশের প্রতিনিধি কাজুয়াকি কাতাওকা ও ঢাকার অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশনের ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কমিশনার বেন কারসন।

ব্যবসা শুরু, জমির প্রাপ্যতা, আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামোসুবিধা, শ্রম নিয়ন্ত্রণ, বিরোধ নিষ্পত্তি, বাণিজ্য সহজীকরণ, কর পরিশোধ, প্রযুক্তি গ্রহণ, ঋণের প্রাপ্যতা এবং পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ ও মান—এই ১১ সূচকের ওপর ভিত্তি করে জরিপটি করা হয়েছে। এই ১১ সূচকের মধ্যে বিদায়ী অর্থবছরে ছয়টি সূচকের অবনতি হয়েছে। উন্নতি হয়েছে পাঁচ সূচকের। মূলত খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা, পরিবহন, নির্মাণ, ইলেকট্রনিকস ও হালকা প্রকৌশল, চামড়া ও ট্যানারি, কৃষি ও বনায়ন, আবাসন, খাদ্য ও পানীয়, ওষুধ ও রাসায়নিক, তৈরি পোশাক, বস্ত্র এবং আর্থিক মধ্যস্থতাকারী—এই ১২ খাতের ওপর জরিপটি করা হয়।

বিবিএক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোনো সূচকের মান ১০০ নম্বরের মধ্যে ০-৪০ হলে ব্যবসার পরিবেশ কঠিন, মান ৪১ থেকে ৬০ হলে ব্যবসায় বেশ কিছু বাধা রয়েছে, মান ৬১ থেকে ৮০ হলে পরিবেশ উন্নতির দিকে এবং মান ৮১ থেকে ১০০ হলে পরিবেশ ব্যবসাবান্ধব।

এ দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যের পরিবেশ নিয়ে টানা দেড় দশক ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ বা সহজে ব্যবসা সূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বের ১৯০টি দেশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটি তৈরিতে অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় ২০২০ সালের পর প্রতিবেদনটি প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৮তম। ২০২০ সালে সংস্থাটির ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছিল ৪৫।

এবারের বিবিএক্সের জরিপ অনুযায়ী, ১১টি সূচকের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে খারাপ করেছে ঋণের প্রাপ্যতা সূচকে, প্রাপ্ত নম্বর ৪০ দশমিক ০৭। যদিও সূচকটির নম্বর আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই সূচকে প্রাপ্ত নম্বর ছিল ২৮ দশমিক ১১। বিদায়ী অর্থবছরে ব্যবসা শুরুর সূচকেরও উন্নতি হয়েছে। এই সূচকে প্রাপ্ত নম্বর ৬৪ দশমিক ৭২, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৬২ দশমিক ৭৪। এ ছাড়া বিদায়ী অর্থবছর জমির প্রাপ্যতা সূচকের প্রাপ্ত নম্বর বেড়ে ৫৪ দশমিক ১০; বিরোধ নিষ্পত্তি সূচকের নম্বর ৬৪ দশমিক ৭৩; কর পরিশোধ সূচকের নম্বর বেড়ে হয়েছে ৫৫ দশমিক ৩৮।

জরিপের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছর ব্যবসায়িক অবকাঠামো সূচকের অবনতি হয়েছে। এই সূচকের প্রাপ্ত নম্বর ৬৮ দশমিক ৮২, যা আগের বছর ছিল ৭১ দশমিক ০৮। বিবিএক্সের পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমানে লোডশেডিং সব খাতের জন্য গুরুতর সমস্যা। গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ পেতে অনানুষ্ঠানিক অর্থ প্রদানের মতো ঘটনা ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে তুলছে।

এ ছাড়া অবনতি হয়েছে আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি সূচকের, প্রাপ্ত নম্বর ৬৭ দশমিক ৭০, শ্রম নিয়ন্ত্রণ সূচকের নম্বর কমে ৬৮ দশমিক শূন্য ৯২, বাণিজ্য সহজীকরণ সূচকের নম্বর ৫৯ দশমিক ৫৬; প্রযুক্তি গ্রহণ সূচক ৬২ দশমিক ৪৬ এবং পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ ও মান সূচকে প্রাপ্ত নম্বর ৫০ দশমিক ১৮।

বিবিএক্সের তথ্যানুযায়ী, দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে ব্যবসার পরিবেশ ভালো বরিশালে। বিদায়ী অর্থবছর বরিশালে ব্যবসার পরিবেশ সূচকে অর্জিত পয়েন্ট ৬২ দশমিক ৮। তারপর সিলেটে ৬১ দশমিক ৫, ময়মনসিংহে ৬১ দশমিক ৫, চট্টগ্রামে ৬০ দশমিক ১, রাজশাহীতে ৫৯ দশমিক ৫, ঢাকায় ৫৯, খুলনায় ৫৮ দশমিক ৮ এবং রংপুরে ৫৬ দশমিক ৯ পয়েন্ট।