আগামী দিন ডিজিটাল লেনদেনের

দেশে ক্রেডিট কার্ডের বাজার বড় হয় সিটি ব্যাংকের হাত ধরে। বিশেষত অ্যামেক্স কার্ডকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়ার পর। এই সেবার ভবিষ্যৎ, কার্ডের বর্তমান ব্যবসা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন

মাসরুর আরেফিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিটি ব্যাংক

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে। মানুষের জীবনমানেরও উন্নয়ন হচ্ছে। সে তুলনায় দেশে ক্রেডিট কার্ডের বাজার কতটা বড় হয়েছে?

মাসরুর আরেফিন: দেশে ক্রেডিট কার্ডের চাহিদা ও গ্রাহকসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। করোনার মধ্যেও ক্রেডিট কার্ডের বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি ছিল। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ক্রেডিট কার্ডের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ। আর ২০২০ থেকে ২০২১ সালে প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ। আমার মনে আছে, ২০১৮ সালে দেশে মোট ক্রেডিট কার্ড ছিল ১৩ লাখের কম। এখন তা বেড়ে প্রায় ১৯ লাখ হয়েছে। তার মধ্যে আমাদের ব্যাংকেরই সক্রিয় ক্রেডিট কার্ড এখন সাড়ে পাঁচ লাখ। এটা গেল কার্ডসংখ্যার কথা।

এবার কার্ডে লেনদেনের তথ্য দেখা যাক। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে কার্ডে লেনদেন বেড়েছে ৫০ শতাংশ। এখন বছরে দেশে কার্ডে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এর মধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে সিটি ব্যাংকের কার্ডে। পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) মেশিনেও লেনদেন বেড়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে পিওএসে লেনদেন বেড়েছে ৫২ শতাংশ। সারা দেশে এখন ৮৩ হাজার পিওএসে লেনদেন হচ্ছে বছরে ২৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার কোটি টাকা সিটি ব্যাংকের লেনদেন।

এখন কিউআর কোডকেন্দ্রিক লেনদেনও বেশ বাড়ছে। দেশে অনলাইনভিত্তিক লেনদেন এখন বছরে ৮০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ২৭ হাজার কোটি টাকা পিওএসে। বাকি ৫৩-৫৪ হাজার কোটি টাকা মুঠোফোন থেকে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে। যদিও কিউআর লেনদেনের বড় একটা অংশ হচ্ছে বিভিন্ন মার্চেন্ট পয়েন্টে ‘ক্যাশ আউট’। আমরা সিটি ব্যাংকের পক্ষ থেকে ২০ হাজারের বেশি দোকানে কিউআর কোডের ব্যবস্থা করেছি। তবে এই বাজারটা এখনো বিকাশের নিয়ন্ত্রণে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ক্রেডিট কার্ডের বাজার বড় করতে ব্যাংক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, মার্চেন্ট ও গ্রাহকদের কী ধরনের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

মাসরুর আরেফিন: দুঃখের বিষয়, ক্রেডিট কার্ড জিনিসটা এখনো এ দেশে মধ্যম ও উচ্চ আয়ের মানুষের প্লাস্টিকের ঋণ হিসেবে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। বৃহত্তর জনমানুষের লেনদেন মাধ্যম হয়ে ওঠেনি। কারণ, ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার জন্য কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক। ব্যবস্থাটি শিথিল করে নিম্ন আয়ের মানুষকে কার্ডের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। প্রয়োজনে এমএফএসের লেনদেন বিবরণী বা আয়ের সনদ দেওয়ার মাধ্যমে তাদের গ্রাহক করা যেতে পারে। আবার জাতীয় পরিচয়পত্রের বদলে ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং ডিজিটাল ন্যানো লোনের মতো ছোট কেওয়াইসিতে বিবেচনায় নেওয়া গেলে এ দেশে ক্রেডিট কার্ডের ভূগোল ও ইতিহাস দুটোই বদলে যাবে।

এ ছাড়া কার্ডের বাজার বড় হওয়ার পেছনে গ্রাহকদেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। তাঁদের কার্ডের ঋণ সময়মতো শোধ করা উচিত, যাতে ব্যাংকগুলোর এ ব্যাপারে সাহস বাড়ে। আবার মার্চেন্টরাও যদি ক্রেডিট কার্ড বের করে নগদ টাকা না চান এবং ব্যাংকগুলো রিওয়ার্ড পয়েন্ট প্রোগ্রামে উদারভাবে আসে, তাহলে বাজারের চিত্র বদলে যাবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে অ্যামেক্সের মাধ্যমে। এ কারণে সিটি ব্যাংক এখনো এ ব্যবসার শীর্ষে। বাজারে এ অবস্থান ধরে রাখতে আপনাদের ব্যাংকের পরবর্তী পরিকল্পনা কী?

মাসরুর আরেফিন: আমাদের মূল পরিকল্পনা মোটা দাগে দুটি। প্রথমত, এরই মধ্যে আমরা বিকাশের সঙ্গে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ডিজিটাল ন্যানো ঋণ চালু করেছি। এখন এসব মানুষকে ক্রেডিট কার্ডও দিতে চাই। হতে পারে তাদের ক্ষেত্রে ঋণসীমা কম হবে। দ্বিতীয়ত, নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কার্ডের লেনদেনকে সহজ করতে চাই। এ ছাড়া দেশের আনাচকানাচে পিওএস এবং কিউআর কোড বসিয়ে ডিজিটাল লেনদেন উৎসাহিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্ড অ্যাম্বাসেডর বসিয়ে কার্ডের সেবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যেতে চাই। অন্যদিকে অ্যামেক্স কার্ডের রিওয়ার্ড পয়েন্টকে আরেকটা কারেন্সি হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন রয়েছে আমার। আবার সব কার্ড স্পর্শবিহীন (কন্ট্যাক্টলেস) হোক, ফোনের মধ্যে ভার্চ্যুয়াল থাকুক, এটাও চাই।

এ মুহূর্তে অ্যামেক্স ক্রেডিট কার্ডে আরও নির্দিষ্ট বিশেষ দুই ফোকাস রয়েছে। তার একটি অ্যামেক্স ইসলামিক ক্রেডিট কার্ড এবং ‘সিটি আলো’ নারী ব্যাংকিং ক্রেডিট কার্ড। ঢাকা বিমানবন্দরে অ্যামেক্স লাউঞ্জ খোলার পর অ্যামেক্স কার্ডের চাহিদা বেড়ে গেছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: পাঁচ বছর পর দেশে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কেমন হবে বলে মনে করছেন?

মাসরুর আরেফিন: দেশে টিআইএনধারী রয়েছেন ৭৫ লাখ, কিন্তু ক্রেডিট কার্ড ১৮ থেকে ১৯ লাখ। আমি মনে করি কার্ড প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকের রক্ষণশীলতা কাটিয়ে ওঠা গেলে এবং সরকারের নীতিসহায়তা পাওয়া গেলে আগামী এক বছরেই এ সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়াতে পারে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের ওপর লেনদেন কার্ডের মাধ্যমে করার একধরনের বাধ্যবাধকতা আনা গেলে দেশে মানুষের আয়-ব্যয়ের বিষয়টাতে কী পরিমাণ স্বচ্ছতা আসতে পারে, চিন্তা করে দেখুন। সরকারের রাজস্ব আদায় তখন অনেক বেড়ে যাবে।