এ বছরই ‘ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও ঋণ’ সেবা চালু করতে চায় নগদ

মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’

মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) চালুর মাত্র তিন বছরেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং কোটি কোটি গ্রাহকের কাছে পৌঁছে গেছে সরকারি–বেসরকারি খাতের উদ্যোগে চালু হওয়া এমএফএস সেবা ‘নগদ’। মাত্র কয়েক বছরেই প্রতিষ্ঠানটি এ বাজারে বেশ কিছু ক্ষেত্রে চমক দেখিয়েছে।

ঘরে বসেই মুঠোফোনে সহজে হিসাব খোলা, কম খরচে দেশজুড়ে গ্রাহকদের আর্থিক লেনদেন সুবিধা দেওয়া ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরব উপস্থিতি—এ তিন কারণেই মূলত অল্প দিনেই নগদ পৌঁছে গেছে কোটি কোটি গ্রাহকের হাতের মুঠোয়। প্রত্যন্ত জনপদ থেকে শুরু করে শহরের গলিপথ—সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে মুঠোফোনে আর্থিক লেনদেনের এ সেবা।

নগদের কার্যক্রম শুরুর তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে সরকারি ডাক বিভাগ এবং বেসরকারি কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে নগদ নামে নতুন এমএফএস সেবাটি চালু করে।

মাত্র তিন বছরেই এ সেবার মাধ্যমে দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোটি কোটি গ্রাহক প্রতিদিন গড়ে ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক লেনদেন করছেন। দেশের প্রায় ২৭ হাজার প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম এখন নগদ। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার এজেন্ট সরাসরি যুক্ত নগদের সেবা কার্যক্রমে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের সেবা ব্যবহার করেও নগদ হিসাবে টাকা আনা ও খরচ যাচ্ছে। শুরু থেকেই প্রচলিত আর্থিক সেবার পাশাপাশি গ্রাহকদের ইসলামিক লেনদেন সুবিধা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। মাত্র ৩৬ মাসে নগদ হয়ে উঠেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান।

২০১৯ সালে ‘নগদ’ সার্ভিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ফাইল ছবি: পিআইডি

বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি নগদের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান ডাক বিভাগ যুক্ত থাকায় সরকারি বিভিন্ন সেবা প্রদানের ক্ষেত্রেও নগদ এখন বড় ভরসার নাম। নগদের মাধ্যমে বয়স্ক ভাতা থেকে শুরু করে সরকারি নানা ধরনের ভাতা পৌঁছে যাচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ঘরে। মাত্র তিন বছরেই নগদের নিবন্ধিত গ্রাহকসংখ্যা ছাড়িয়েছে ৬ কোটির বেশি। অল্প সময়ে বিপুল গ্রাহক শ্রেণি তৈরি হওয়ায় এখন সেবার পরিধি বাড়ানোর নতুন নতুন পরিকল্পনা করছে নগদ কর্তৃপক্ষ। তারই অংশ হিসেবে চলতি বছরের মধ্যে ‘ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও ঋণ’ কার্যক্রম শুরু করতে চায় নগদ। নতুন এ সেবা চালু হলে তা নগদের কার্যক্রমে আরও গতি সঞ্চার করবে বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও ঋণসেবা চালু করা নিয়ে আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি। নতুন এ সেবা চালু করতে পারলে একদিকে গ্রামের কৃষকের স্ত্রীও যেমন সঞ্চয় করতে পারবেন, তেমনি ছোট দোকানদারেরা ৩৩ শতাংশের চড়া সুদ থেকে মুক্তি পাবেন।’

ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও ঋণসেবা চালু করা নিয়ে আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি। নতুন এ সেবা চালু করতে পারলে একদিকে গ্রামের কৃষকের স্ত্রীও যেমন সঞ্চয় করতে পারবেন, তেমনি ছোট দোকানদারেরা ৩৩ শতাংশের চড়া সুদ থেকে মুক্তি পাবেন।
তানভীর আহমেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), নগদ

জানা যায়, ২০১৭ সালে সরকার মোবাইল ব্যাংকিং সেবার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। সেই দরপত্রে অংশ নেয় থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি। থার্ড ওয়েভ কাজটি পায় এবং বেসরকারি মালিকানায় ডাক বিভাগের সেবা নগদের কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন মেলে। ২০১৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথমে পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে নগদের যাত্রা শুরু হয়। পরে একই বছরের ২৬ মার্চ নগদের আনুষ্ঠানিক সেবার উদ্বোধন হয়। শুরু থেকেই এটি ডিজিটাল কেওয়াইসির (গ্রাহকসম্পর্কিত তথ্য) মাধ্যমে হিসাব খোলার ব্যবস্থা করে।

সরকারি ডাক বিভাগের সেবা হওয়ায় শুরু থেকে অন্যান্য এমএফএস প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বাড়তি কিছু সুবিধা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যার সুফল গ্রাহকেরাও পেয়েছেন। এ কারণে অল্প সময়ে বিপুল গ্রাহক তৈরি হয় নগদের। এমএফএস প্রতিষ্ঠান হলেও নগদ এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান নয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। নগদসহ এমএফএস সেবাকে জনপ্রিয় করতে এরই মধ্যে ‘মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বিধিমালা ২০২২’ জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এমএফএস সেবার কার্যক্রমের জন্য লাইসেন্স পাবে।

নগদকে অনুমোদন দিতে কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি শর্তগুলো পরিপালন করে এখনো লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেনি। আবেদন করলে আমরা বিবেচনা করে দেখব।
সিরাজুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র , বাংলাদেশ ব্যাংক

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগদকে অনুমোদন দিতে কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি শর্তগুলো পরিপালন করে এখনো লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেনি। আবেদন করলে আমরা বিবেচনা করে দেখব।’

এদিকে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই দেশজুড়ে সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন ভাতা ও প্রণোদনা প্রকৃত সুবিধাভোগীদের কাছে পৌঁছে দিতে অনন্য ভূমিকা রাখছে নগদ। তিন বছরের পথচলায় সহজে গ্রাহক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টিকে প্রতিষ্ঠানটির সাফল্যের বড় ভিত্তি বলে মনে করেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘দেশে মাত্র ৩০ শতাংশ গ্রাহক স্মার্টফোন ব্যবহার করে। তাই সবার ডিজিটাল হিসাব খোলার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় মুঠোফোন অপারেটরদের কাছে জমা দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা হিসাব খোলার উদ্যোগ নিই। এ কারণে নগদের গ্রাহকের বড় অংশই এসেছে গ্রামীণফোন, রবি, টেলিটকের মাধ্যমে।’

একনজরে নগদ

  • নিবন্ধিত গ্রাহক: ৬ কোটি ৮ লাখ (২২ মার্চ পর্যন্ত), সক্রিয় অর্ধেক।

  • লেনদেন: দৈনিক গড়ে ৭৫০ কোটি টাকা।

  • সেবার খরচ: বিনা মূল্যে টাকা পাঠানো ও সর্বনিম্ন ক্যাশ-আউট চার্জ।

  • বাজারে অবস্থান: গ্রাহকসংখ্যা ও লেনদেনে দেশের দ্বিতীয় সেরা এমএফএস।

  • উদ্ভাবন: ই-কেওয়াইসির প্রচলন ও *১৬৭# ডায়াল করে হিসাব খোলার সুযোগ।

  • বিশেষত্ব: ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরকারি ভাতা ও সহায়তা বিতরণে নেতৃত্ব।

  • নগদ ইসলামিক: এমএফএস খাতে দেশে প্রথম ইসলামিক সেবা।

এদিকে শুরু থেকেই দেশের অন্যান্য এমএফএস প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সেবা মাশুল বা আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে খরচ কম নিচ্ছে নগদ। ফলে নগদের প্রতি গ্রাহকের ঝোঁকও বেড়েছে বহুগুণ। প্রতিযোগিতার বাজারে গ্রাহক ধরতে সেবা মাশুল কমিয়ে দিয়ে তবে কি লোকসান গুনছে নতুন প্রতিষ্ঠানটি—এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগদের এমডি বলেন, ‘মোটেই তা নয়। নানা ধরনের সেবা দিয়ে আমাদের লোকসান নেই। এক সেবা থেকে মুনাফা না হলেও অন্য সেবা থেকে আয় আছে। এ কারণে লোকসান হয় না। আবার আমরা সেবা মাশুল কমানোর কারণে অন্যরাও কমিয়েছে। যার সুফল পাচ্ছেন এমএফএস গ্রাহকেরা।’