তথ্য তালাশে আপত্তি বিএসইসির

বিএসইসির সঙ্গে কয়েক মাস ধরে মতভিন্নতা চলছে। সেগুলোর সমাধান না হতেই সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর তথ্য চাইল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

বেশ কিছু ঘটনায় ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে কয়েক মাস ধরে রেষারেষি চলছে। এ রকম অবস্থায় ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ নভেম্বর সম্পদ ব্যবস্থাপনা (অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট) কোম্পানিগুলোর সম্পদ ও দায়ের তথ্য চেয়ে তাদের চিঠি দিয়েছে। এর জেরে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাল্টা চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) চিঠি দেয়। এর আট দিন পর ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরকে পাল্টা চিঠি পাঠায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। চিঠিতে কোম্পানিগুলোর কাছে এভাবে তথ্য চাওয়া থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশ মেনে তথ্য চাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, আর্থিক জরিপ কার্যক্রমে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (ওএফসি) সম্পদ ও দায়ের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জরিপের ফরমে কিছু পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে। চিঠিতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর সম্পদ ও দায়ের পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত মিউচুয়াল ফান্ডসমূহের সম্পদ এবং দায়ের তথ্যও লাগবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ৫১টি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি লাইসেন্স তথা নিবন্ধন নিয়েছে। এর মধ্যে ৪১টি কোম্পানি কার্যকর ও ১০টি অকার্যকর রয়েছে। কার্যকর কোম্পানিগুলো বর্তমানে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ব্যবস্থাপনা করছে। এর বাইরে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি রয়েছে আরও ২১টি।

জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি অ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ডসের সভাপতি (এএএমসিএমএফ) হাসান ইমাম বলেন, বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাওয়া তথ্য দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বিএসইসির মূল আপত্তি

সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া চিঠির জেরে গভর্নরকে লেখা বিএসইসির চিঠিতে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজার অত্যন্ত সংবেদনশীল। এই বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মধ্যস্থতাকারীদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে তদারকির দায়িত্ব পালন করে তারা। প্রত্যেক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও পক্ষের কাছে থাকা তথ্য মূল্য সংবেদনশীল হতে পারে, যা বিএসইসির অনুমোদন ছাড়া বা অনুমোদিত পন্থা ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহ ও প্রকাশ করা যায় না। বিদ্যমান ১৯৬৯ সালের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশের ১৯ ধারায় এসব তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

যোগাযোগ করলে বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম গত মঙ্গলবার বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েই আমরা সব জানিয়েছি।’ এর বাইরে তিন কিছু বলতে চাননি।

পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে তা বিএসইসির মাধ্যমে সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। বিএসইসি বলেছে, ‘পুঁজিবাজারের সংবেদনশীলতা বিবেচনায় এবং বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার উদ্দেশে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরাসরি কোনো তথ্য, উপাত্ত বা প্রতিবেদন চাওয়া থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সবার সহযোগিতা কাম্য।’

প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে বিএসইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, খেলাপি ঋণ আবার এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তি দুর্বল, পুরো খাতে সুশাসনের ঘাটতি আছে। অথচ মূল কাজ এড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পুঁজিবাজার-সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে বেশি মনোযোগী হয়েছে। কখনো কখনো এখতিয়ারের বাইরে গিয়েও হস্তক্ষেপ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা ভুল বার্তা দিতে পারে।

বিএসইসির একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা জানান, তথ্য-উপাত্ত চাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে যে একটা সাধারণ চর্চা রয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই চিঠিতে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। যেমন বিএসইসি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সিআইবি তথ্য জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়, সরাসরি ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কিছু বলে না। তেমনি বিমা কোম্পানির তথ্য জানতেও চিঠি পাঠানো হয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে।

দুই সংস্থার সাম্প্রতিক মতভিন্নতা

শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ খতিয়ে দেখতে গত আগস্ট মাসে ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস পরিদর্শন শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে প্রতিদিন প্রতিবেদন চেয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দেয়। সেটাকে বিএসইসি ভালোভাবে দেখেনি।

‘পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল’ নামে কয়েক মাস আগে একটি তহবিল গঠন করে বিএসইসি। লক্ষ্য ছিল, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির অবণ্টিত লভ্যাংশ ওই তহবিলে জমা হবে। এ নিয়েও দুই সংস্থার অবস্থান ভিন্নমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী অদাবিকৃত লভ্যাংশের অর্থ স্থিতিশীলতা তহবিলে যাওয়ার সুযোগ নেই। যারা এরই মধ্যে এ ধরনের অর্থ জমা দিয়েছে, তা ফেরত আনতে হবে। অন্যদিকে বিএসইসির মত হচ্ছে, এ অর্থ বিনিয়োগকারীর এবং তা এ তহবিলেই স্থানান্তরিত হবে।

বেসরকারি ওয়ান ব্যাংক গত বছর আর্থিক প্রতিবেদনে অসত্য তথ্য দিয়েছিল। বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আয়োজন ও লভ্যাংশ বিতরণের পরে ওই প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে ওয়ান ব্যাংককে দুটি চিঠি পাঠিয়ে নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংকটি কোনো পরিবর্তন আনেনি।এ কারণে ওয়ান ব্যাংককে জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এর সরাসরি বিরোধিতা করে বিএসইসি। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে গভর্নর ফজলে কবিরের উদ্দেশে বিএসইসি বলেছে, ওয়ান ব্যাংকে পাঠানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-১ ও অফ সাইট সুপারভিশন বিভাগের দুটি চিঠির বিষয়ে কমিশন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। বিএসইসি জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে লভ্যাংশের পরিমাণ নির্ধারণ আইনসংগত নয়। লভ্যাংশের পরিমাণ নির্ধারণ করা শেয়ারহোল্ডারদের মৌলিক অধিকার। চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত স্থগিতের জন্য গভর্নরের হস্তক্ষেপ চায় বিএসইসি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে সাড়া দেয়নি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তথ্য-উপাত্ত সব সময় চাওয়া হয়। আইএমএফসহ অন্যান্য সংস্থা তথ্য চেয়ে থাকে। এগুলো সরবরাহ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। এখানে অন্য কোনো বিষয় নেই।